অনলাইন ডেস্ক :
বিএনপি জাতীয় সরকার ও দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠনের ঘোষণা দিয়েছে। ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাব সামনে রেখে তারা এ প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে নির্বাচনী সমন্বয়ে’ জোর দিচ্ছে। আগামীর রাজনৈতিক পথচলা, আসন বণ্টন ও ক্ষমতার অংশীদারিত্ব প্রশ্নে বিভিন্ন দলের সঙ্গে সমন্বয় করেই ভোটযুদ্ধে লিপ্ত হতে চায় বাংলাদেশের অন্যতম দল বিএনপি। ফলে দলটির পরিকল্পনা থেকে বাদ পড়ছে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দল ও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী।বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণ প্রশ্নে এখনই কোনো সিদ্ধান্তে যেতে চাচ্ছে না বিএনপি। বৈষম্যবৃদ্ধি ছাত্র আন্দোলনের জনরোষে পালিয়ে যাওয়া দল আওয়ামী লীগের ব্যাপারে নির্বাচনের আগে পরিস্থিতি বুঝে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে তারা। একই সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর উচ্চাভিলাষী হয়ে ওঠা বাংলাদেশ জামায়াতের সঙ্গে তৈরি দূরত্ব গোছানোর কথা ভাবছেন না জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। বরং জামায়াত ছাড়া ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেওয়া অন্যান্য দলের সঙ্গে সমন্বয় করে নির্বাচন করতে চাচ্ছেন তারা।বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির মহাসচিব বর্তমানে অস্ট্রেলিয়া সফরে আছেন। আপাতত তিনি এসব নিয়ে মন্তব্য করতে চাননি। মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম কৌশলী বক্তব্যে বলেছেন, দেশের উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আমাদের মধ্যে যোগাযোগ হওয়া স্বাভাবিক এবং ভবিষ্যতেও তা হওয়া উচিত।এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর তথ্যসূত্রে জানা যায়, ফ্যাসিবাদী সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী সব দলকে নিয়ে তারা সামনের দিকে অগ্রসর হতে চান। এবং সবাই একসঙ্গে আছেন। কয়েক দিন আগেও যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের সঙ্গে সিরিজ বৈঠক হয়। সেখানে বিএনপি বিজয়ী হলে সবাইকে নিয়ে জাতীয় সরকার গঠন করতে চায়।বিএনপি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে এই বার্তা জানানো হয়েছে। নির্দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন দাবিতে আমাদের আন্দোলন চলমান। যতক্ষণ জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার না আসছে, তা থাকবে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জামায়াতে ইসলামী স্বাধীন রাজনৈতিক দল। তারা তাদের মতো কার্যক্রম চালাচ্ছে। নির্বাচনী জোট সময় ও পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করবে।বিএনপির দলীয় সূত্র থেকে জানা যায়, সমমনা দলের সঙ্গে ঐক্য বজায় রাখতে তৎপরতার পাশাপাশি সাংগঠনিকভাবে দলকে শক্তিশালী করার উদ্যোগ নিয়েছে বিএনপি। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মাঠ পর্যায়ে নেতাকর্মীর নেতিবাচক কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে কঠোর অবস্থান নিয়েছে দলটি। ইতোমধ্যে অনেককে বহিষ্কার ও শোকজ করা হয়েছে।বিএনপি সূএ থেকে আরো জানা যায়
আওয়ামী লীগের ভাগ্য নির্ধারণের ব্যাপারে ইতোমধ্যে প্রাথমিক মতামত দিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব। তিনি জানিয়েছেন, দল হিসেবে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করার পক্ষে না। তবে আওয়ামী লীগের যেসব নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নির্যাতন ও গণহত্যায় জড়িত থাকার প্রমাণ রয়েছে, তাদের বিচার অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে।বিএনপির সিনিয়র নেতারা বলছেন গণঅভ্যুত্থানে পালিয়ে যাওয়া আওয়ামী লীগকে নিয়ে বর্তমানে নানা রকম বিতর্ক চলছে। অনেকে জার্মানি ও ইতালির উদাহরণ দিয়ে তাদের সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করার পক্ষে। আবার কেউ কেউ বলছেন, টানা তিন নির্বাচনে অংশগ্রহণ বন্ধ রাখা দরকার।আওয়ামী লীগের ব্যাপারে সরকারের ভূমিকা কী এবং জনগণ কী চায়, তা পর্যবেক্ষণ করছে বিএনপি। অন্তর্বর্তী সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় নতুন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের তৎপরতা নিবিড়ভাবে দেখছে। আবার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যসহ পশ্চিমা শক্তি কী চায়, তাও পর্যালোচনা করছে বিএনপি। নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক পরিস্থিতি কী হবে, তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করবে বলে জানান নেতারা।
সতর্ক নজরে জামায়াত
আওয়ামী লীগ সরকারের পতন আন্দোলনে জামায়াতের সঙ্গে জোট না থাকলেও ভেতরে ভেতরে ঐক্য ছিল বিএনপির। তবে পতনের পর জামায়াতের বর্তমান তৎপরতায় অসন্তুষ্ট এবং কার্যক্রম নিয়ে সতর্কতা অবলম্বন করছে দলটি। বিএনপি নেতাদের মতে, জামায়াত পরিকল্পিতভাবে বিএনপির সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করছে। তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে তারা এককভাবে মতামত দিয়েছে। বিশেষ করে নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে বিএনপির সঙ্গে দ্বিমত করে বক্তব্য-বিবৃতি দিচ্ছে। বিএনপি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পন্ন করে যৌক্তিক সময়ের মধ্যে নির্বাচন দাবি করলেও জামায়াত বলছে ভিন্ন কথা। তাদের ভাষ্য, রাষ্ট্রীয় সংস্কার শেষ করার পরই নির্বাচন হওয়া উচিত। আবার স্বৈরাচারী দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে ক্ষমা এবং বাংলাদেশের গণতন্ত্র হরণের দায়ে অভিযুক্ত ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়েও এককভাবে মতামত দিয়েছে জামায়াত, যা ভালোভাবে নেয়নি বিএনপি। দলটির নেতাদের মতে, যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত জামায়াত উচ্চাভিলাষী হয়ে উঠেছে। বিএনপির মতো বৃহত্তর দলের সঙ্গে মাঠে প্রভাব বিস্তার ও প্রশাসনের পদ পদবিতে দল সমর্থিত পেশাজীবীদের পদায়নে প্রতিযোগিতা করছে। আদালতে সরকারি আইন কর্মকর্তা নিয়োগ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণে তারা মরিয়া।উদাহরণ দিয়ে বিএনপি নেতারা বলেন, ইতোমধ্যে বিএনপির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কিছু রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পদে জামায়াত সমর্থিত পেশাজীবী চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছেন। যেমন– অ্যাটর্নি জেনারেল পদে নিয়োগ পান বিএনপির মানবাধিকার-বিষয়ক সম্পাদক আসাদুজ্জামান। অন্যদিকে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে চিফ প্রসিকিউটর নিয়োগ পেয়েছেন সাবেক জামায়াত নেতা ও এবি পার্টির যুগ্ম আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম। যদিও বিএনপি নেতাকর্মী নিজ নিজ এলাকায় আধিপত্য বজায় রাখতে ব্যস্ত, আর জামায়াত মাঠ সুসংহত করার পাশাপাশি প্রশাসনে দল সমর্থিত লোক বসাতে ব্যস্ত। জামায়াত নেতারা জানিয়েছেন, স্বাধীন-গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল হিসেবে তারা কার্যক্রম চালাচ্ছেন। এতে কোন দল কী মনে করল, তা ভাবার সময় এখন নয়। নির্বাচন এলে পরিস্থিতি বুঝে সিদ্ধান্ত নেবেন– কোনো দলের সঙ্গে সমঝোতা হবে কিনা। তাই এখন তারা দল গোছাচ্ছেন।সূত্র জানায়, এমন পরিস্থিতিতে জামায়াতকে বাইরে রেখেই আগামী নির্বাচনের হিসাব কষছে বিএনপি। ভোটের মাঠে জামায়াতের নেতৃত্বে নতুন রাজনৈতিক জোট হওয়ার সম্ভাবনা মাথায় রেখে বাকি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আসন সমন্বয়ের মাধ্যমে বিজয়ী হলে জাতীয় সরকার গঠনে এগিয়ে যাচ্ছে তারা। সাবেক মিত্র হলেও বর্তমানে দল দুটি রাজনীতির মাঠ দখলে প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠছে।
জাতীয়পার্টির বিষয়ে নমনীয় বিএনপি
বিভিন্ন সূত্র জানায়, জাতীয় পার্টির ব্যাপারে কঠোর মনোভাব পোষণ করে না বিএনপি। দলটির মূল্যায়ন, ২০১৪ সালের নির্বাচনে জাপা অংশ নিতে চায়নি। প্রতিবেশী ভারতের হস্তক্ষেপে নির্বাচনে যেতে বাধ্য হয়। ২০১৮ সালে জাপার মতো বিএনপিও অংশ নিয়েছে। ২০২৪ সালে নির্বাচন বর্জনের চেষ্টা করেছিল জাপা। কিন্তু রাষ্ট্রীয় শক্তির চাপের মুখে শেষ পর্যন্ত যেতে হয়। ফলে জাপার বিরুদ্ধে কঠোর সিদ্ধান্ত না নেওয়ার পক্ষে দলটির নেতারা। যদিও আওয়ামী লীগ সরকারের স্বৈরাচারের সহযোগী অভিযুক্ত করে অন্তর্বর্তী সরকার এ দলকে সংলাপে এখন পর্যন্ত ডাকেনি।
আগামী নির্বাচন সামনে রেখে অতীতের মতো যুগপৎ আন্দোলনের শরিক ৪২ দলের সঙ্গে ঐক্য ধরে রাখতে চায়, এমন বার্তা দিতে ইতোমধ্যে তাদের সঙ্গে পৃথকভাবে বৈঠক করেছেন বিএনপি নেতারা। যদিও নির্বাচনের আগে চাওয়া-পাওয়া নিয়ে বিএনপির সঙ্গে দলগুলো দরকষাকষি করবে। বিএনপি তাদের জাতীয় সরকারের অংশীদার করার আশ্বাস দিয়ে অতীতের মতো জোটবদ্ধ থাকার আহ্বান জানিয়েছে। দলগুলো বিএনপির প্রতি আস্থা রেখে একসঙ্গে পথ চলতে আগ্রহ দেখিয়েছে।