গোলাম সারোয়ার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ব্যুরো প্রধান
খোলামেলা চারপাশ, মাথার ওপর রয়েছে টিন। পিলারের সঙ্গে বাঁধা আছে ছোট আকৃতির আয়না আর টেবিল। বসার স্থান বলতে রয়েছে ১টি কাঠের চেয়ার। ছোট আকারের একটি আর টেবিলে রাখা আছে কাঁচি, চিরুনি, কাপড়, আর ক্ষুরসহ কিছু জিনিসপত্র। খোলামেলা পরিবেশে নানা বয়সী লোকদের কাটছেন চুল।
এমন দৃশ্য দেখা যায়, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া পৌর শহরের বড়বাজার এলাকায়। মৎস্য আড়তে নিরাপদ শীল নামে এক নরসুন্দর মনের আনন্দে সারছেন চুল কাটার কাজ।
তিনি প্রায় দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে খোলা জায়গাতে চুল কাটার কাজ করছেন। সকাল ৮টা-দুপুর ২টা পর্যন্ত কাজ নিয়মিত করে আসছেন। এতে তার দৈনিক কাজ করে ২০০-২৫০ টাকা আয় হয়। আর এ টাকা দিয়ে চলছে তার জীবিকা।
এক সময় নরসুন্দরদের গ্রামের হাট-বাজারে কিংবা বড় রাস্তার পাশে খোলা আকাশের নিচে চুল কাটতে দেখা যেতো। কিন্তু ডিজিটালের যুগে সেলুনের দাপটে খোলা আকাশের নিচে তাদের কাঁচি, ক্ষুর কর্মের এই দৃশ্য অনেকটাই যেন বিরল হয়ে আছে। চুল কাটার এমন দৃশ্য যেন সহসায় চোখে পড়ে না। কালের বিবর্তনে তা আজ অনেকটাই স্মৃতিতে রূপান্তরিত হয়ে আছে।
এদিকে, শহর থেকে শুরু করে গ্রাম-গঞ্জের হাট- বাজারে সর্বস্থানে যেন এখন আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। এমনকি চুল কাটাতে ব্যবহৃত হচ্ছে ইলেকট্রিক মেশিনও। সেই সঙ্গে চুল কাটা হচ্ছে ছবি দেখে আলাদা আলাদা স্টাইল বা ডিজাইনে। দ্রুতই হয়ে যাচ্ছে নানাবিধ স্টাইল। কিন্তু এরপরেও ঘুরে ফিরে পূর্বের সেই দৃশ্য বড় বাজার এলাকায় কদাচ দেখা যায়। ডিজিটাল যুগে আগের ন্যায় দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে নরসুন্দরের কাজ করে আসছেন পৌর শহরের রাধানগরের বাসিন্দা নিত্তরঞ্জন শীলের ছেলে নিরাপদ শীল। তার পরিবারে স্ত্রী, ১ ছেলে ১ মেয়ে রয়েছে।
নিরাপদ শীল বলেন, খোলামেলা জায়গায় ও খোলা আকাশের নিচে আমার দাদা, বাবা এ কাজ করেছেন। তাদের হাত ধরে আমি এই কাজ শিখেছি। পড়াশোনা না থাকা ও অন্য কোন কাজ জানা না থাকায় ইচ্ছা থাকা সত্বেও যেতে পারিনি। তাই পরিবারের অভাব অনটন দূর করতে আমার ১৫ বছর বয়স থেকেই খোলা আকাশের নিচে রোদ বৃষ্টি অপেক্ষা করে এ কাজ করছি।
সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, বড়বাজার মৎস্য আড়তের ভেতরে খোলামেলা জায়গার মধ্যে নিরাপদ শীল একটি ভাঙা চেয়ারের মধ্যে গ্রাহককে বসিয়ে গায়ে একটি কাপড় জড়িয়ে তারপর চুল কাটার কাজ করছেন। চুল কাটা আসা লোকজন দাঁড়িয়ে থেকে অপেক্ষা করছেন। কারণ নেই তার এখানে কোনো বসার ব্যবস্থা। তাছাড়া এই জায়গাতে নেই কোনো বিদ্যুতের সংযোগ। এখানে মূলত অসহায় হতদরিদ্র ব্যক্তি ছাড়া চুল কাটাতে তেমন কেউ আসে না।
নিরাপদ শীল আরো বলেন, আমার এখানে প্রতি জন থেকে চুল কাটা শেভসহ ৩০ টাকা নেয়া হয়। আমার কিছু নিয়মিত গ্রাহক রয়েছেন তারা সব সময় এখানে এসে চুল কাটাসহ শেভ করছেন। তার এ কাজের গ্রাহক হচ্ছেন দিনমজুর, শ্রমিক, নিম্ন আয়ের লোকজন। আকাশ ভালো থাকলে দৈনিক ২০০-২৫০ টাকার উপর কাজ হয়।
বড়বাজার এলাকার সবুজ মিয়া বলেন, ছোট বেলা থেকেই ঐ লোকটাকে মৎস্য আড়তে চুল কাটার কাজ করতে দেখে আসছি। বাজার করতে আসা লোকজন তার কাছে গিয়ে শেভ কিংবা চুল কাটতে দেখা যায়।
দিনমজুর বাচ্চু মিয়া বলেন, এমনিতে আয় রোজগার কম। ভালো কোনো সেলুনে গিয়ে চুলকাটা আর শেভ করতে ৫০ টাকা দিতে হয়। যখনই চুল কাটা কিংবা শেভ করতে হয় তখন এখানেই আসা হয়। এখানে কম টাকায় চুল কাটা ও শেভ করা যায়।
সদর উপজেলার এলাই মিয়া বলেন, আগে তার বাবার কাছ থেকে চুল কাটা ও শেভ করতাম। এখন তার কাছ থেকে ওইসব করা হয়। বড় কোনো সেলুন থেকে চুল কাটা ও শেভ করলে নিচে ৫০ টাকা দিতে হয়। এখানে ২৫-৩০ টাকার মধ্যে কাজ করা যায়। তাই এখানে আসা।
বড় বাজার মৎস্য আড়ৎ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. রফিকুল ইসলাম সেন্টু মোল্লা বলেন, নিরাপদ শীল খুবই অসহায় মানুষ। দীর্ঘ বছর ধরে আমাদের মৎস্য আড়তে সময় করে চুল কাটার কাজ করছেন। এতে আমাদের কোনো প্রকার সমস্যা হয়না।