গোলাম সারোয়ার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ব্যুরো প্রধান/
উপজেলার একটি মাধ্যমিক স্কুল। সেই স্কুলের ল্যাবে ডু মারলে চোখে ঠেকবে নানা যন্ত্রাংশ। সেগুলো নিয়ে
কাজ করছে বিজ্ঞানমনস্ক একদল শিক্ষার্থী। আলাপ করলে জানতে পারবেন, শিক্ষক ও বড় ভাইদের
তত্ত্বাবধানে তারা রোবোটিকস নিয়ে কাজ করে। এমনকি এ স্কুল প্রাঙ্গণে তৈরি রোবটের জুটেছে আন্তর্জাতিক পুরস্কারও।
বিদ্যালয়ের নাম আশুগঞ্জ তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়। জেলার আশুগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত এ
বিদ্যালয় থেকে এ বছরই এসএসসি পেরিয়েছে মাহদির ইসলাম। পঞ্চম বিশ্ব উদ্ভাবন প্রতিযোগিতা ও
প্রদর্শনীতে অংশ নিতে মাহদিরের নেতৃত্বে শিক্ষার্থীদের একটি দল কিছুদিন আগে গিয়েছিল মালয়েশিয়া।
সেখানে ১৯টি দেশের ৪০৯টি দলের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে তাদের তৈরি কৃষিভিত্তিক রোবট ও হেক্সাকপ্টার
ড্রোন জিতেছে প্রথম পুরস্কারসহ স্বর্ণপদক। এ ছাড়া আশুগঞ্জ তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র উচ্চবিদ্যালয়ের বিজ্ঞানের
শিক্ষক মঈন উদ্দিন পেয়েছেন সেরা তত্ত্বাবধায়কের পুরস্কার।
২০১৭ সালে স্কুলের বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক মঈন উদ্দিনের সহায়তায় শখের বশে রোবট ও রোবোটিকস
সম্পর্কে জানতে শুরু করে মাহদির ও তার বন্ধুরা। একসময় তারা বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে শুরু
করে। উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে অনুষ্ঠিত বিজ্ঞান মেলা থেকে যোগ হতে থাকে পুরস্কার।
পরবর্তীতে ২০২১ সালে রোবোটিকস চর্চার জন্য ‘ড্রিমস অব বাংলাদেশ’ নামে একটি দল গঠন করে মাহদির।
পরের বছরই নটর ডেম কলেজের সায়েন্স ক্লাব আয়োজিত ‘নটরডেম অ্যানুয়াল সায়েন্স ফেস্টিভ্যাল’
প্রতিযোগিতায় ছয়টি দেশের মধ্যে ‘প্রজেক্ট ডিসপ্লে’ বিভাগে চ্যাম্পিয়ন হয় ‘ড্রিমস অব বাংলাদেশ’। একই
বছর অক্টোবর মাসে ভারতের নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত টেকনোক্সিয়ান ওয়ার্ল্ড রোবোটিকস চ্যাম্পিয়নশিপেও
অংশগ্রহণ করে এ দলটি। ৫৩টি দেশের মধ্যে রোবো রেস বিভাগে চতুর্থ স্থান অর্জন করে তারা।
এ বছর মাহদিরের সঙ্গে বিশ্ব উদ্ভাবন প্রতিযোগিতা ও প্রদর্শনীতে (ডব্লিউআইসিই) অংশ নিয়েছিল ঢাকার
মাইলস্টোন কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র সাদমান সাঈদ, আশুগঞ্জ তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র উচ্চবিদ্যালয়ের নবম
শ্রেণির ছাত্র আতিফ রহমান ও আবদুল কাদির মোল্লা এবং ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের ‘এ’লেভেলের ছাত্র সানজিম
হোসেন। সাদমানও আশুগঞ্জ তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেছে। দলের
ব্যবস্থাপক হিসেবে আছে ঢাকার বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায়
অংশ নেওয়া আতিফ আবরার রহমান।
মাহদির বলছিল, ‘আমি যেহেতু ঢাকায় চলে এসেছি, তাই ড্রিমস অব বাংলাদেশও এখন আর শুধু স্কুলের
গণ্ডিতে আবদ্ধ নেই। ইচ্ছা আছে আরও নানা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছেলেমেয়েদের যুক্ত করার। তবে আমাদের
আশুগঞ্জ স্কুলেও রোবোটিকস চর্চা চলবে। মঈন স্যার তো আছেনই। আমিও প্রায় প্রতি সপ্তাহেই স্কুলে যাই।
জুনিয়রদের প্রশিক্ষণ দিই। প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে দায়িত্ব এখন আরও বেড়ে গেছে।’
ডব্লিউআইসিইর পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে গত ২৬ সেপ্টেম্বর। মাহদির বলল, ‘পুরস্কার হিসেবে আমরা
পেয়েছি পাঁচটি স্বর্ণপদক, ক্রেস্ট, সনদ, চ্যাম্পিয়ন অ্যাওয়ার্ড, গণিত ও বিজ্ঞান ক্লাব বিশেষ পুরস্কার ও তিন
লাখ ইন্দোনেশিয়ান রুপি। সেরা তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে মঈন স্যার বালিতে অনুষ্ঠেয় একটি আয়োজনে অংশ নেওয়ার আমন্ত্রণ পেয়েছেন।’
ড্রিমস অব বাংলাদেশ মূলত কৃষিকাজে সহায়তার জন্য একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন রোবট তৈরি করেছে।
এই রোবট মাটির প্রকৃতি বুঝে বীজ বপন করতে পারে। জমিতে সেচ দেয়া, উপযুক্ত ও অনুপযুক্ত মাটি শনাক্ত
করা, এসবও করতে সক্ষম। এ ছাড়া মাহদিরদের তৈরি হেক্সাকপ্টার (কৃষি ড্রোন) ফসল ও পশুসম্পদ পর্যবেক্ষণে সহায়তা করবে।
আশুগঞ্জ তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র উচ্চবিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্র আতিফ বলল, ‘এই নিয়ে দ্বিতীয়বার দেশের
বাইরে গেলাম আমরা। বিজয়ী দল হিসেবে আমাদের নাম ঘোষণার পর বাংলাদেশের পতাকা উড়ানো হয়েছে,
জাতীয় সংগীত বেজেছে। এ অনুভূতি বলে বোঝানো সম্ভব নয়।’ দলের আরেক সদস্য সাদমান যোগ করল, ‘দেশের প্রতিনিধিত্ব করতে পেরেছি, এটাই বড় আনন্দ।’
১৪ অক্টোবর সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত আশুগঞ্জ তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র উচ্চবিদ্যালয়ের ল্যাব ঘুরে, শিক্ষক-
শিক্ষার্থী ও বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে বিজ্ঞানের প্রতি তাঁদের বিশেষ আগ্রহ আছে বলে বুঝা গেলো।
স্কুলের প্রধান শিক্ষক ইয়াকুব ভূঞা বলেন, ‘বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক মঈন স্যারসহ অন্যান্য শিক্ষক মিলে
ল্যাবটি গুছিয়েছেন। আমাদের ছেলেরা পুরস্কার অর্জন করেছে, তাদের নিয়ে আমরা অত্যন্ত গর্বিত। আশুগঞ্জ
পাওয়ার স্টেশন কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এএমএম সাজ্জাদুর রহমান এই চার শিক্ষার্থীকে
চারটি ল্যাপটপ উপহার দিয়েছেন। আমরা শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানমনস্ক করার পরিকল্পনা করছি। প্রতিবছর স্কুলে
বড় পরিসরে বিজ্ঞান মেলা আয়োজনের পরিকল্পনা রয়েছে।’
বিজ্ঞানের শিক্ষক মঈন উদ্দিন বলেন, ‘স্কুলে পড়ার সময় থেকেই বিজ্ঞান নিয়ে কাজ করার প্রবল আগ্রহ ছিল।
নিজে যে সহায়তাটা পাইনি, চেয়েছি আমার ছাত্ররা সেটা পাক। আজকের এই ল্যাব আমাদের দীর্ঘ পাঁচ
বছরের কষ্টের ফসল। শিক্ষার্থীরা অনেক সময় ঈদের পোষাক না কিনে ডিভাইস কিনেছে। জমানো টাকা
ল্যাবের কাজে খরচ করেছে। প্রতিষ্ঠান থেকেও আমরা অনেক সহায়তা পেয়েছি। একেবারে শিশু শ্রেণি থেকে
শুরু করে স্কুলের যে কোনো ক্লাসের শিক্ষার্থীই ল্যাবের সদস্য হতে পারে