রিপন কান্তি গুণ, বিশেষ প্রতিনিধি নেত্রকোনা;
নেত্রকোনার দুর্গম হাওরাঞ্চলের লক্ষাধিক জনগোষ্ঠীর একমাত্র সম্বল ‘খালিয়াজুরী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স’। ৩১ শয্যাবিশিষ্ট সরকারি এ হাসপাতালটিতে ডাক্তার-কর্মচারীর সংকটে ব্যহত হচ্ছে চিকিৎসা সেবা।হাসপাতালের তথ্য সূত্রে জানাগেছে, সরকারি এ হাসপাতালটিতে জুনিয়র কনসালট্যান্টসহ ১৩টি ডাক্তার পদের মধ্যে ৭টি পদ’ই শূন্য, বাকি ৮টি পদের বিপরীতে পোস্টিং থাকলেও এদের মধ্যে ৭ জন ডাক্তারই অন্যান্য হাসপাতালে কর্তব্যরত (প্রেষণে) রয়েছেন।.এ হিসেবে খালিয়াজুরী উপজেলা কমপ্লেক্সে কর্তব্যরত ডাক্তার আছেন মাত্র একজন। ফলে একমাত্র ডাক্তারের ওপর নির্ভরশীল এখানকার বিশাল জনগোষ্ঠীর চিকিৎসা সেবা।কৃষ্ণপুর থেকে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা রিমন চৌধুরীর (৩৫) সাথে কথা বললে তিনি বলেন, আমার মাথায় আঘাত পাওয়ায় ৪টি সেলাই করিয়েছি। কিন্তু যারা সেলাই করে দিয়েছেন কোন ডাক্তার ছাড়াই তারা ঔষধ লিখে দিয়েছেন। ভাল চিকিৎসার আশায় প্রায় তিন ঘন্টা ধরে একজন এমবিবিএস ডাক্তার খুঁজেছি কিন্তু কোন ডাক্তার না পেয়ে বাড়ি ফিরে যাচ্ছি। পরে মোহনগঞ্জের কোন প্রাইভেট ডাক্তার দেখিয়ে নিব। আমি আর্থিকভাবে স্বচ্ছল বলে প্রাইভেট ডাক্তার দেখাচ্ছি কিন্তু নিম্ন আয়ের মানুষ কীভাবে এ হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা পাবে? তাই আমার দাবি হাসপাতালটিতে ডাক্তারের সংখ্যা বাড়ানো হোক।একটি বেসরকারি সংস্থায় (এনজিও) কর্মরত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দু’জন উন্নয়ন কর্মী জানান, গত ২৫ সেপ্টেম্বর বেলা ১ টার দিকে মাথা ব্যাথা ও শরীরের দুর্বলতা কাটানোর চিকিৎসা নিতে গিয়ে হাসপাতালটিতে তারা কোনো ডাক্তার পাননি। একই কথা জানান, খালিয়াজুরীর মেন্দিপুর গ্রামের সোহেব মিয়ার স্ত্রী সুফিয়া আক্তার (৫৫), তিনিও চিকিৎসা নিতে গিয়েছিলেন খালিয়াজুরী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বহিঃর্বিভাগে। সেখানে অনেক খোঁজাখুঁজি করেও কোন ডাক্তার পাননি তিনি। ডাক্তার না পেয়ে সুফিয়া আক্তার আক্ষেপ করে আঞ্চলিক ভাষায় বলেন, ‘খাইল্ল্যাজুরী হাসপাতালে কোনো ডাক্তর খুঁইজ্যা পাইলাম না। ট্যাহার অভাবে অইন্য কোনোখানেও চিকিস্যা নিতে যাইতাম পারতাম না। তাই অহন চিকিস্যা ছাড়াই মরণ লাগব আমরার মতো গরিব মানুষগর।’স্থানীয় অনেকেই জানান, এ হাসপাতালে প্রায়শই কোন ডাক্তার খোঁজে পাওয়া যায় না। সে ক্ষেত্রে জটিল ও জরুরি চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের মৃত্যু ঝুঁকি শুধু বেড়েই চলে। হাওর জনপদ খালিয়াজুরী উপজেলায় সরকারি এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি ছাড়া অন্য কোন হাসপাতাল কিংবা ক্লিনিক নেই। ২০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ভবন সাদৃশ্য এ হাসপাতালে কোন রোগীর ৫০ টাকা খরচের রোগ সনাক্তকরণের প্রয়োজন হলে মিলে না তেমন কোন পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থাও। ফলে রোগীকে দুরের পথ পেরিয়ে যেতে হয় নেত্রকোনা কিংবা মোহনগঞ্জ পৌর শহরে। এতে রোগীদের পোহাতে হয় চরম দুর্ভোগ ও অপচয় হয় অধিক বেশি অর্থের। দুর্গম এ খালিয়াজুরীতে গর্ভবতী জটিল রোগীদের চিকিৎসা সেবা পাওয়া দুষ্প্রাপ্য। তাই এখানে মা ও শিশু মৃতের হার অন্যান্য উপজেলার চেয়ে অনেকটা বেশি। এখানকার হাসপাতালটিতে কোন গর্ভবতী মায়ের সিজারিয়ান অপারেশন কখনো হয়নি। ডাক্তার, প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি এবং ব্লাড ব্যাংকের অভাবে অপারেশন থিয়েটারটি অচল বয়েছে। ডাক্তার সংকটের কারণে তেমন কোন চিকিৎসাই মিলে না এখানে। জনবল সংকটের কারণে বেশির ভাগ সময়ই হাসপাতালটি অপরিচ্ছন্ন থাকে।হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত পরিসংখ্যানবিদ রফিকুল ইসলাম জানান, এ হাসপাতালে মোট পদের সংখ্যা ১০৯টি। এর মাঝে ৫০টি পদই শূন্য। হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পদ রয়েছে ৪টি। এর মাঝে জুনিয়র কনসালট্যান্ট সার্জারি পদটি শূন্য। অন্য তিনটি পদ জুনিয়র কনসালট্যান্ট মেডিসিন, গাইনি ও অবস পদের বিপরিতে তিন জনের পোস্টিং থাকলেও এসব ডাক্তার এখানে নেই। তারা প্রেষণে রয়েছেন অন্যান্য হাসপাতালে। তাছাড়া সহকারী ডেন্টাল সার্জন ও আয়ূর্বেদিক দুটি পদের বিপরীতে থাকা দুজন ডাক্তারও প্রেষণে আছেন দীর্ঘদিন ধরে। মেডিকেল অফিসারের দুটি পদ রয়েছে শূন্য। হাসপাতালটিতে চিকিৎসা দেয়ার জন্য ডাক্তার হিসেবে আছেন শুধু একজন আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও)।খালিয়াজুরী উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. সৌনম বড়ুয়ার সাথে প্রায়ই ডাক্তার অনুপস্থিত থাকার বিষয়ে কথা বললে তিন বলেন, হাসপাতালে প্রায়ই ডাক্তার অনুপস্থিত থাকেন কথাটি সত্য নয়। হাসপাতালের প্রতিটি সংকটের কথাই মাসিক ও বিশেষ প্রতিবেদনের মাধ্যমে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হচ্ছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ডাক্তার সংকট কাটাতে সিভিল সার্জন আপাতত পার্শ্ববর্তী অন্যন্য হাসপাতাল থেকে এনে এখানে দুজন করে ডাক্তার সংযুক্তি দিচ্ছেন প্রতি দুই সপ্তাহের জন্য।তিনি আরও জানান, হাসপাতালটিকে ৩১ শয্যা থেকে ৫০ শয্যায় উন্নীতকরণে ভবন নির্মাণ হয়েছে প্রায় এক বছর আগে। কিন্তু প্রশাসনিক অনুমোদন ও জনবল না থাকায় সেটি এখনো চালু করা সম্ভব হয়নি।