বিশেষ কলাম
শিক্ষা, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক বন্ধ্যাত্ব শফিকুল ইসলাম
শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি একটি জাতির স্বরূপ অন্বেষায় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিশ্বের জাতিসমূহের দরবারে একটি বিশেষ জাতির অবস্থান কোথায়, তা চিহ্নিত করা যায় তার শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি আলোক সম্পাৎ করে। কারণ শিক্ষা একটি জাতির অবয়ব নির্মাণ করে, সাহিত্যে সে অবয়বের প্রতিফলন ঘটে আর সংস্কৃতি তাকে পূর্ণতা দান করে। এভাবেই একটি জাতির পরিচয় বিধৃত হয় তার শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে। তাই যে-কোন জাতির বৈশিষ্ট্য ও স্বকীয়তার সাথে তার শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। বলা বহুল্য যে, মুসলিম জাতির বেলায়ও কথাটি হুবহু প্রযোজ্য।
দুনিয়ায় সাধারণত বর্ণ, গোত্র, ভাষা বা ভূখণ্ডকে কেন্দ্র করে এক-একটি জাতির অবয়ব নির্মিত হয়। তাদের শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতেও তাই এসব বৈশিষ্টের প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়; এগুলোকে কেন্দ্র করেই তাদের জীবন-চক্র আবর্তিত হয়। ফলে তাদের স্বাতন্ত্র্য ও স্বকীয়তা উপলব্ধি করতে কিছুমাত্র বেগ পেতে হয় না; বরং অনেক ক্ষেত্রে বাহ্যিক অবয়ব ও অভিব্যক্তি দেখেই তাদের জাতিসত্তার প্রকৃত স্বরূপটি উপলব্ধি করা যায়। কিন্তু ইসলামের ক্ষেত্রে ব্যাপারটি একটু ভিন্নতর।
ইসলাম দুনিয়ায় এক মহত্তম আদর্শের উদ্বোধক। বর্ণ, গোত্র, ভাষা ও ভূখণ্ডের কৃত্রিম ভেদ-রেখার ঊর্ধ্বে এটি এক বিশ্বজনীন চেতনা। এক আল্লাহর অকৃত্রিম বন্দেগী ও অখন্ড মানবিক সমতা হচ্ছে এই আদর্শের ভিত্তিভূমি আর এটাই মুসলিম জাতিসত্তার মূল উপাদান। তাই একটি আদর্শবাদী মুসলিম জাতির শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে ওঠে ইসলামী চিন্তা-দর্শনের ভিত্তিতে, তার সাহিত্যে প্রতিফলিত হয় ইসলামী ভাবাদর্শের সার-নির্যাস আর তার সংস্কৃতিতে বাঙ্ময় হয়ে ওঠে ইসলামের সূক্ষ্ণ নান্দনিকতা। এ কারণে মুসলিম জাতিসত্তা দুনিয়ার অন্যান্য জাতিসত্তা থেকে গুণগতভাবে পৃথক ও স্বতন্ত্র ভাবাদর্শে সমুজ্জ্বল।
ইসলামের সোনালী যুগে মুসলিম জাতিসত্তার এটাই অনন্য বৈশিষ্ট্য আর এ বৈশিষ্ট্যের কারণেই দুনিয়ার জাতিসমূহের দরবারে মুসলিম জাতির অবস্থান ছিল আপন স্বকীয়তায় ভাস্বর। জ্ঞানচর্চা, জীবন-সাধনা, রাষ্ট্র-শাসন সর্বত্রই মুসলমানদের হাতে ছিল ‘আলাদীনের জাদুর চেরাগ’। তাদের নির্মিত নতুন সমাজ ও সভ্যতার স্পর্শে মাত্র চার দশকের মধ্যেই এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের বিরাট অঞ্চলে মানবতার নব-জাগৃতি ঘটেছিল এবং যুগ-যুগান্ত কালের অজ্ঞতার যবনিকা অপসৃত হয়েছিল। কোন বর্ণ, গোত্র, ভাষা বা অঞ্চলের কারণে নয়, শুধুমাত্র ইসলামের জাদু-স্পর্শেই এই অভাবনীয় বিপ্লব সংঘটিত হতে পেরেছিল। এমনকি প্রথম তিন দশকের সংক্ষিপ্ত সময়-পরিসরে তৎকালীন দুনিয়ার বড় বড় রাজা-বাদশাহ এবং রোম ও পারস্যের ন্যায় দু’দুটি পরাশক্তি তাদের পদতলে এসে লুটিয়ে পড়েছিল।
আজ সেই মুসলিম জাতি শুধু নিজের প্রভাব প্রতিপত্তিই হারায়নি, অমুসলিম জাতিগুলোর কাছে সে করুণার পাত্রেও পরিণত হয়েছে। সময়ের বিবর্তনে তার আকার-আকৃতি বৃদ্ধি পেয়েছে বটে; কিন্তু তার আদর্শিক বৈশিষ্ট্য ও নৈতিক গুণাবলী বহুলাংশেই লোপ পেয়েছে। কারণ ইসলামের সুমহান আদর্শের পরিবর্তে মুসলমানরা আজ বর্ণ, ভাষা ও অঞ্চলের ভিত্তিতে খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে পড়েছে যা তাদের জাতিসত্তাকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলেছে। তারা ইসলামী শিক্ষা-দর্শন পরিহার করে পাশ্চাত্যের জড়বাদী শিক্ষাদর্শনকে গ্রহণ করেছে; তাদের সাহিত্যে নৈতিক মূল্যবোধের পরিবর্তে ভোগবাদী চিন্তা-দর্শনের প্রতিফলন ঘটছে; তাদের কৃষ্টি সংস্কৃতিতে নির্মল সৌন্দর্য-বোধের পরিবর্তে উৎকট নগ্নতা ও অশ্লীলতা ছায়াপাত করছে। এর ফলে আজকের মুসলিম জনগোষ্ঠী নৈতিক ও আদর্শিক মূল্যবোধ হারিয়ে কার্যত এক বিশৃংখল জনারণ্যে পরিণত হচ্ছে। এই চরম বিপর্যয় থেকে মুসলিম জাতিকে উদ্ধার করার জন্যে আজকে প্রয়োজন হয়ে পড়েছে তার প্রকৃত স্বরূপ অন্বেষার; তার হারানো বৈশিষ্ট্য ও স্বকীয়তাকে ফিরিয়ে এনে তাকে নতুনভাবে বিশ্বের দরবারে উপস্থিত করার।আধুনিকতা’র নামে পাশ্চাত্য শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি যে মুসলিম জাতিকে একটি মেরুদণ্ডহীন জনগোষ্ঠীতে পরিণত করছে এবং তাদেরকে ধ্বংসের অতল গহ্বরে ঠেলে দিচ্ছে।বাংলাদেশের শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে বর্তমানে এক নিদারুণ বন্ধ্যাত্ব চলছে।
এ বন্ধ্যাত্বের অবসান ঘটানোর জন্যে আজ প্রয়োজন সাহসী লোকদের এক বলিষ্ঠ উদ্যমের- প্রয়োজন নৈতিক চেতনায় উজ্জীবিত একটি গণ-বিস্ফোরণের। কাংখিত সেই গণ-বিস্ফোরণকে সম্ভব করে তোলার জন্য দরকার স্বতন্ত্র ভাবনা ।আজ সময় এসেছে আমাদের মাঝে বিভাজন ভেঙে পরিবার সমাজ ও রাষ্ট্রের অবকাঠামো নির্মাণে এগিয়ে আসা।
ডিবিপি / সারোয়ার জাহান