গোলাম সারোয়ার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ব্যুরো প্রধান জেলার আশুগঞ্জে ব্যবসায়ীদের গলার কাঁটায় পরিণত হয়েছে ‘শিল্প ও পণ্য মেলা’। করোনা মহামারির প্রাদুর্ভাবে সারা বছর ব্যবসায় মন্দা যাওয়ার পর বাণিজ্যে কিছুটা প্রাণ ফিরতে শুরু করলে তাতে বাগড়া বসাচ্ছে এই ‘শিল্প ও পণ্য মেলা’। এ যেন মরার উপর খাঁড়ার ঘা। অসময়ে ‘শিল্প ও পণ্য মেলা’ আয়েজনে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের মাঝে অসন্তোষ ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। উপজেলা নির্বাহী অফিসারের সম্মেলন কক্ষে ঈদুল আজহা উপলক্ষে আয়োজিত প্রস্তুতিমূলক সভায় ব্যবসায়িক ক্ষতির কথা উল্লেখ করে এ মেলা বন্ধের দাবী জানান সংক্ষুব্ধ ব্যবসায়ীরা।
জানা যায়, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রশাসন কয়েকটি শর্তে আদিবাসী মহিলা উন্নয়ন সংস্থার নামে একটি সংগঠনকে স্থানীয় সরকারি শ্রমকল্যাণ কেন্দ্রের মাঠে (১৫ জুন থেকে ৩০ জুন) ১৫ দিনের জন্য এ মেলার অনুমতি দেয়। শুরু থেকেই মেলা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসনের শর্ত ভঙ্গ, অব্যবস্থাপনা, নিন্মমানের বিভিন্ন পণ্য বিক্রি ও অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগের অভিযোগ উঠেছে। এছাড়া পক্ষকালের অনুমোদন নেয়া হলেও মেলার প্রচার করা হচ্ছে মাসব্যাপী শিল্প ও পণ্য মেলা হিসেবে।
ইতোমধ্যে মেলায় দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ৩৫ টি স্টল তাদের পণ্যের পশরা সাজিয়ে কেনা বেচা শুরু করে দিয়েছে। স্টলগুলোর মধ্যে রয়েছে কসমেটিকস, কাপড় ও ব্যাগ, চুড়ি-গহনা, কুটিরশিল্প ইত্যাদি। এছাড়া ৩টি রাইডার এবং ‘ভুতের বাড়ি’ নামে একটি প্রদশর্নীও রয়েছে। মেলায় সর্বসাধারণের প্রবেশমুল্য ১০ টাকা। এছাড়া প্রতিটি রাইড উপভোগে রয়েছে অতিরিক্ত ৫০ টাকার আলাদা টিকেট।
স্থানীয় ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, আশুগঞ্জ বন্দর ও শিল্প নগরী হলেও এখানকার স্থায়ী ব্যবসা এলাকা সীমিত এবং মুলত আশুগঞ্জ বাজার কেন্দ্রিক। বিগত কয়েক বছরে করোনা মহামারিসহ নানা কারণে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত-বিপযস্ত। লোকসানের কারণে অনেকে ব্যবসা গুটিয়ে চলে গেছেন। সাধারণত দুটি ঈদে কিছু বেচাকেনার আশায় তারা সারাবছর দোকান ভাড়া দিয়ে কোন রকমে টিকে রয়েছেন। এ অবস্থায় শহরের প্রাণ কেন্দ্রে শিল্প ও পণ্য মেলার আয়োজন স্থানীয় ব্যবসায়ীদের চরম ক্ষতির কারণ। তারা জানায়, মেলার কারণে বিকালের পরে বস্ত্র, কসমেটিকস, ব্যাগসহ মেয়েদের ব্যবহার্য দোকানগুলো একেবারেই ক্রেতাশুন্য থাকছে। ঈদের আগে কিছু বেচা-কেনা আশায় তারা দোকানে অতিরিক্ত মালামাল তুললেও মেলার কারণে তা ভেস্তে গেছে। এ অবস্থায় তারা ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দসহ প্রশাসনের কাছে মেলা বন্ধের দাবী জানান।
এদিকে প্রশাসনের নির্দেশনা মত, মেলায় দায়িত্বরতদের গলায় আইডি কার্ড ব্যবহার না করা, উচ্চ শব্দে মাইক বা সাউন্ডবক্স বাজানো, অব্যবস্থাপনাসহ জেলা প্রশাসনের বিভিন্ন শর্ত অমান্য করা, নিন্ম মানের পণ্য বিক্রি ও চোরাই লাইনে বিদ্যুৎ ব্যবহার করে আলোকসজ্জাসহ বিভিন্ন দোকানে সংযোগ দেয়ার অভিযোগ- মেলা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে।
সরেজমিনে মেলায় গিয়ে দেখা গেছে, দায়িত্বরত কারও কাছেই আইডি কার্ড নেই। এমনকি দায়িত্বরতরা নিজেদের নাম-পরিচয় প্রকাশ করতে অনিহা প্রকাশ করেন। তবে ‘ভুতের বাড়ি’ প্রদশর্নীর দায়িত্বে থাকা মোঃ জসিম নিজেকে মেলার কর্মচারি বলে পরিচয় দেন। নিষেধ সত্বেও উচ্চস্বরে সাউন্ড বক্স ও মাইক কেন ব্যবহার করা হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি মাইক বন্ধ করে দেন। তিনি আরো জানান, বেলা ১১ টা থেকে রাত ১০-১১ টা পর্যন্ত এসব রাইডার ও মেলা চলে। কেন স্কুল চলাকালীন সময়ে ছোট শিশু কিশোরেরা ‘ভুতের বাড়ি’ প্রদশর্নীতে টিকেট দেয়া হয়-জানতে চাইলে তিনি এসব মূলত শিশুদের জন্যই বলে জানান। যদিও বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রকৌশলী মোঃ জাহাঙ্গীর খন্দকার এসব ভীতিকর প্রদশর্নী শিশুদের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর বলে জানিয়েছেন।
মেলায় আসা ফারজানা নামে এক তরুণী জানান, মেলার পণ্যগুলো মুলত ওয়ানটাইম ও নিম্নমানের। দামও বেশি। এরচেয়ে কম দামে মার্কেট থেকে কেনা যায় জানিয়ে তিনি আরো বলেন শখের বশে কেনাকাটা করে বিব্রত হয়েছি। একই কথা জানান আইনুন্নাহার, কবিতা ও সানজিদা নামের নামের আরো তিন কিশোরী।
এব্যাপারে আশুগঞ্জ বস্ত্র ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মাকসুদুর রহমান বলেন, সারাবছর দোকান খুলে বসে থেকে ঈদ উপলক্ষে আমাদের দোকানগুলোতে লাখ লাখ টাকার মালামাল উঠানো হয়। অথচ মেলার রমরমা প্রচারণায় ক্রেতারা মার্কেটে না এসে মেলায় ছুটছে। তার অভিযোগ, এতে একদিকে নিন্মমানের পণ্য কিনে ক্রেতা প্রতারিত হচ্ছেন অন্যদিকে বন্দরের স্থায়ী ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
আশুগঞ্জ কসমেটিক ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আউয়াল মিয়া ও ফরহাদ মিয়া বলেন, মেলার স্থানটি বাজারের মধ্যে হওয়ায় বন্দরের ব্যবসায়ীরা চরম ক্ষতির মুখে পড়েছে। তারা মেলাটি বন্ধের দাবী জানান।
পার্শ্ববর্তী মার্কেটের নিউ নাফ টেলিকমের মোঃ ফাহিম উচ্চ মাত্রার শব্দের কারণে দোকানে কাজ করতে পারেন না বলে জানান।
আশুগঞ্জ শহর শিল্প ও বণিক সমিতির সভাপতির গোলাম হোসেন ইপটি বলেন, সাধারণত এ জাতীয় মেলার আয়োজন করা হয়ে থাকে ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারি মাসে। আর ভেন্যু নির্ধারণ করা হয়ে থাকে স্থায়ী মার্কেট ও বিপনী বিতানগুলো থেকে দূরে কোথাও। তিনি বলেন, আশুগঞ্জের ব্যবসায়ীরা খুব ভাল নেই। বিগত কয়েক বছরে করোনা মহামারিসহ নানা কষাঘাতে এখানকার ব্যবসায়ীরা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। দুটি ঈদে বেচাকেনার আশায় সাড়া বছর দোকান ভাড়া দিয়ে কোনরকমে টিকে থাকেন ব্যবসায়ীরা। এ অবস্থায় শহরের প্রাণ কেন্দ্রে শিল্প ও পণ্য মেলার আয়োজন স্থানীয় ব্যবসায়ীদের উপর চপেটাঘাত ছাড়া কিছুই নয়। ঈদকে সামনে রেখে এমন মেলা আমরা মানতে পরছি না। আমরা মনে করি এ মেলার কোন যৌক্তিকতা নেই। শব্দদুষণের কারণে নিজের অফিসে বসেও কথা বলতে পারছেন না তিনি বলে তিনি জানান। ব্যবসায়ীদের স্বার্থে তিনি এ মেলা বন্ধের আহবান জানান।
এদিকে বেশ কয়েকজনের অভিযোগ মেলায় অবৈধ লাইনে চলে বিদ্যুৎ। অস্থায়ী প্রি-প্রেইড মিটারকে কেবল বৈধতা দেখানোর অপ-কৌশল। তবে সরকারি অনুমোদন থাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহে বিদ্যুৎ বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগ থেকে একটি অস্থায়ী মিটার দেয়া হয়েছে জানিয়ে যাচাই করে অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন ও আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানিয়েছেন স্থানীয় বিদ্যুৎ বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগের সহকারি প্রকৌশলী মোঃ জাফর আহমেদ।
এ ব্যাপারে কথা বলতে মেলার আয়োজক সংগঠন আদিবাসী মহিলা উন্নয়ন সংস্থা, সিলেটের সভানেত্রী রাখিমনি সিনহার সাথে একাধিকবার মুঠোফোনে কথা বলার চেষ্টা করলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
2 Attachments • Scanned by Gmail