রিপন কান্তি গুণ, নেত্রকোনা জেলা প্রতিনিধি /
নেত্রকোনা-৫ (পূর্বধলা) আসনের সংসদ সদস্য ওয়ারেসাত হোসেনকে অপহরণের সত্যতা নিয়ে সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে। তাঁর স্ত্রী অভিযোগে বলেন, অপহরণের পর ওয়ারেসাত হোসেনকে প্রায় সাত সপ্তাহ আটকে রাখা হয়েছিল। এরকম অভিযোগ নিয়ে স্থানীয় লোকজনের পাশাপাশি দলের নেতাকর্মীরাই প্রশ্ন তুলেছেন।
তাঁরা বলছেন, আপহরণের যে সময় উল্লেখ করা হয়েছে এ সময়ের মধ্যে সংসদ সদস্য ওয়ারেসাত হোসেন কয়েকবার বিভিন্ন দলীয় কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন। তাই বিষয়টি রহস্যজনক হয়ে উঠেছে।
বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সংসদ সদস্য ওয়ারেসাত হোসেন দীর্ঘ ২০ বছর ধরে পূর্বধলা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। তিনি টানা তিনবারের সংসদ সদস্য। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তিনি অসুস্থ থাকায় কারও সঙ্গে তেমন একটা কথা বলেন না। এ ছাড়া তাঁর স্মৃতিশক্তিও কিছুটা কমে গেছে।
পূর্বধলা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার নিজাম উদ্দিন বলেন, ‘বর্তমান সংসদ সদস্য ওয়ারেসাত হোসেনকে অপহরণের বিষয় নিয়ে যে মামলা করা হয়েছে, তা আমার বোধগম্য নয়। অভিযোগে যে সময় উল্লেখ করা হয়েছে, এ সময়ের মধ্যে তিনি বেশ কয়েকবার নির্বাচনী এলাকায় উপস্থিত ছিলেন এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। এর পেছনে কী এমন গুপ্ত কাহিনী লুকিয়ে আছে, তা পুলিশের সুষ্ঠু তদন্ত করা প্রয়োজন।’
ওয়ারেসাত হোসেনকে অপহরণ, তাঁর স্বাক্ষর জাল, নাম ভাঙিয়ে টাকা আদায় করাসহ বিভিন্ন অভিযোগে গত ২৩ আগস্ট তাঁর স্ত্রী রওশন হোসেন ৯ জনকে আসামি করে পূর্বধলা থানায় একটি মামলা করেন। মামলার আসামিরা সবাই ‘এমপির কাছের লোক’ হিসেবে পরিচিত।
মামলায় প্রধান আসামি করা হয় নাদিয়া আক্তার (২৬) নামের স্নাতকোত্তর পড়ুয়া এক তরুণীকে। এ ছাড়া তরুণীর ছোট ভাই পূর্বধলা সরকারি কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তাইফকে (২০) দুই নম্বর আসামি করা হয়েছে। অন্য আসামিদের মধ্যে আছেন পূর্বধলা উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি সোলায়মান হোসেন, সংসদ সদস্যের ঘনিষ্ঠ (পিএস) হিসেবে পরিচিত ফেরদৌস আলম (৪২), কামরুজ্জামান উজ্জ্বল (৪২), দুই কলেজশিক্ষক নাদেরুজ্জামান স্বপন (৪২), রতন পাল (৩২), ছাত্রলীগ কর্মী শাহ আলীম (৩২) ও সংসদ সদস্যের গাড়িচালক শফিকুল ইসলাম (৪৫)।
পূর্বধলা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সংসদ সদস্যের আত্মীয় জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘অপহরণের ঘটনাটি রহস্যজনক। এ নিয়ে সবার মধ্যে সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে। মানুষের মুখে শুনেছি, এমপির ছত্রছায়ায় থেকে তাঁর লোকজন প্রচুর টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। দ্বিতীয় বিয়ের বিষয়টিও মানুষের মুখে শুনেছি।’ বিষয়টি কতটুকু সত্য তা জানিনা।
পূর্বধলা উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান শেখ রাজু আহমেদ জানান, সংসদ সদস্য ওয়ারেসাত হোসেনের ছত্রছায়ায় থেকে ফেরদৌস আলম ও কামরুজ্জামান উজ্জ্বল সব নিয়ন্ত্রণ করতেন।
তিনি বলেন, ‘শুনেছি ইতিমধ্যে তাঁরা প্রচুর টাকার মালিকও হয়েছেন। মেয়েটিকে (নাদিয়া) নিয়ে এমপির কাছ থেকে সব ধরনের সুবিধা নিতেন ফেরদৌস ও কামরুজ্জামানসহ কয়েকজন। এসব বিষয় নিয়ে হয়তো মামলা হয়েছে।’
মামলার বাদী রওশন হোসেন মামলায় উল্লেখ করেন, আসামিরা একে অপরের যোগসাজশে ওয়ারেসাত হোসেনকে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিতে থাকেন। ফেরদৌস আলম ও কামরুজ্জামান উজ্জ্বলকে সংসদ সদস্য ওয়ারেসাত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও অফিস-আদালতে তাঁর কাজ দেখভালের মৌখিক দায়িত্ব দেওয়ার পর তাঁরা সংসদ সদস্যের নাম ভাঙিয়ে প্রচুর টাকা আত্মসাৎ করেন। অন্য আসামিরা গত ৭ ফেব্রুয়ারি ওয়ারেসাত হোসেনকে ভুল বুঝিয়ে তাঁর গ্রামের বাড়ি কাজলা থেকে একটি গাড়িতে করে ঢাকায় নিয়ে যান। সেখানে সংসদ সদস্যের নিজের বাসা উত্তরায় না নিয়ে ধানমন্ডি এলাকায় একটি বাসায় তাঁকে আটকে রাখা হয়। পরে গাড়িচালক সংসদ সদস্যের পরিবারকে জানান, ওয়ারেসাত হোসেন বিদেশে চলে গেছেন।
মামলায় বাদী আরও উল্লেখ করেন, তাঁর স্বামীকে (ওয়ারেসাত হোসেন) জিম্মি করে স্বাক্ষর জাল করে নাদিয়া আক্তারের সঙ্গে বিয়ের একটি ভুয়া কাবিননামা তৈরি করা হয়। এরপর স্বাক্ষর জাল করে তাঁকে (রওশন হোসেন) তালাকের একটি কাগজ ফটোকপি করে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে দেওয়া হয়।
পরে গত ২৭ মার্চ বিকেলে পরিবারের লোকজন খোঁজাখুঁজি করে ঢাকার একটি বাসা থেকে সংসদ সদস্যকে অসুস্থ অবস্থায় উদ্ধার করেন। পরদিন চিকিৎসার জন্য ওয়ারেসাত হোসেনকে মালয়েশিয়ায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে মেয়ের বাসায় রেখে চিকিৎসা শেষে ১১ আগস্ট দেশে আনা হয়। মামলায় ওয়ারেসাত হোসেনকে প্রধান সাক্ষী করা হয়েছে। এ ছাড়া আরও আটজনকে সাক্ষী করা হয়।
মামলার বিষয়ে প্রধান আসামি নাদিয়া আক্তারের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এসব বিষয় নিয়ে আমি খুবই বিব্রতকর অবস্থায় আছি। তাই এখন এ বিষয় নিয়ে আর কথা বলছি না। সময় হলে সবকিছুই জানতে পারবেন।’
আসামিদের দাবি, যে সময়ে অপহরণের কথা বলা হয়েছে, তখন এলাকায় বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে উপস্থিত ছিলেন সংসদ সদস্য ওয়ারেসাত।
এরমধ্যে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি উপজেলার নারান্দিয়া ইউনিয়নের ভুগী জাওয়ানী উচ্চবিদ্যালয়ের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় প্রধান অতিথি ছিলেন তিনি। গত ১১ মার্চ ময়মনসিংহে প্রধানমন্ত্রীর জনসভায় তিনি যোগ দিয়েছিলেন। ২৩ মার্চ শ্যামগঞ্জ বাজারে আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেন। ২৬ মার্চ উপজেলা পরিষদ হলরুমে বীর মুক্তিযোদ্ধা পরিবারকে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন তিনি।
মামলার ৪ নম্বর আসামি ওয়ারেসাত হোসেনের ব্যক্তিগত সহকারী (পিএস) হিসেবে পরিচিত ফেরদৌস আলম বলেন, ‘আমাদের নামে করা মামলাটি সম্পূর্ণ মিথ্যা, বানোয়াট ও ভিত্তিহীন। এমপি সাহেব ওই সময়ের মধ্যে এলাকায় থেকে বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন। সবকিছুর প্রমাণই আমাদের কাছে আছে।’
বিষয়টি নিয়ে কথা বলার জন্য মামলার পর থেকে গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত ওয়ারেসাত হোসেনের মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তা বন্ধ পাওয়া যায়। আর তাঁর স্ত্রী রওশন হোসেন এসব বিষয় নিয়ে কথা বলতে চান না বলে জানান। পূর্বধলা থানার ওসি মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, মামলাটি গুরুত্বসহকারে তদন্ত করা হচ্ছে।
উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এরশাদ হোসেন বলেন, ‘এসব বিষয় নিয়ে আমি আর কী বলবো? তবে এমপি সাহেব বড়মাপের নেতা, তিনি একজন বীর প্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা ও তিনবারের সংসদ সদস্য। তাঁকে অপহরণ করলে সঙ্গে সঙ্গে তোলপাড় সৃষ্টি হয়ে যাওয়ার কথা ছিল।