রিপন কান্তি গুণ, নেত্রকোনা জেলা প্রতিনিধি/
নেত্রকোনার পূর্বধলা উপজেলার হিরণপুর এলাকার বাসিন্দা জহিরুল-সায়মা দম্পতি। স্ত্রী সায়মা জাহন পলি নিজের কিডনিদিয়ে স্বামীকে নতুন জীবন ফিরিয়ে দিয়ে ভালোবাসার এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
প্রায় বছর খানেক আগে অসুস্থতা জনিত কারণে চিকিৎসকের কাছে যান জহিরুল ইসলাম জুনাইদ (৩৯)। চিকিৎসকের পরামর্শে পরীক্ষা-নিরীক্ষার একপর্যায়ে জানতে পারেন তার দুটি কিডনিই বিকল। অনেক চেষ্টার পরও কোথাও তার জন্য কিডনির কোনো ব্যবস্থা হচ্ছিল না- তখনই তার স্ত্রী স্ত্রী সায়মা জাহান পলি (২৭) নিজের একটি কিডনি দিয়ে স্বামীর জীবন বাঁচাতে এগিয়ে আসেন। তার দেওয়া কিডনিতে এখন সুস্থ হয়ে উঠেছেন জহিরুল হক।
কিডনি প্রতিস্থাপনের পর থেকে জহিরুল ইসলাম জুনাইদ ও তার স্ত্রী সায়মা জাহান পলি বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের সপ্তম তলায় চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
জহিরুল হকের বাড়ি জেলার পূর্বধলা উপজেলার হিরণপুর বাজার এলাকায়। তিনি মো. মোজাম্মেল হক ও জয়নব আক্তার দম্পতির পাঁচ সন্তানের মধ্যে বড় সন্তান। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে জহিরুল একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। তার স্ত্রী সায়মা জাহান নেত্রকোনা সরকারি কলেজ থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে মাস্টার্স পাশ করেন। জহিরুল ও সায়মা দম্পতির জুনাইনা জান্নাত রাইসা নামের পাঁচ বছরের একটি কন্যা সন্তান রয়েছে।
পারিবারিক সূত্রে জানায়ায়, প্রায় ছয় বছর আগে আটপাড়া উপজেলার পাঁচগজ গ্রামের সায়মা জাহানের সঙ্গে জহিরুল হকের বিয়ে হয়। বিয়ের পর তারা একসঙ্গে ঢাকায় থাকতেন। গত ২০২২ সালের (২৭ মে) জহিরুল ছুটি নিয়ে গ্রামের বাড়িতে আসেন। ওই দিন উচ্চ রক্তচাপসহ তার শারীরিক পরিস্থিতি খারাপ অনুভব হলে স্বজনরা তাকে নেত্রকোনা আধুনিক সদর হাসপাতালে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান। সেখানে জরুরি বিভাগের চিকিৎসকরা তাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ (মমেক) হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। পরে ময়মনসিংহে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় তার কিডনি রোগ ধরা পড়ে। এরপর ময়মনসিংহ ও ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নেন তিনি। পরে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকে ডায়ালাইসিস করতে থাকেন। কিন্তু শারীরিক পরিস্থিতি ক্রমশ অবনতির দিকে যাচ্ছিল।
এ অবস্থায় মাস খানেক আগে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে আবারও চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। চিকিৎসক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর জানান- তার দুটি কিডনি অকেজো হয়ে গেছে। তাকে বাঁচাতে হলে কমপক্ষে একটি কিডনি প্রতিস্থাপন করা প্রয়োজন। এর পর বিভিন্ন কিডনি ব্যাংকে যোগাযোগ করেও কিডনি সংগ্রহ করতে পারেননি। এতে পরিবারের লোকজন হতাশ হয়ে পড়েন। পরে পরীক্ষায় জহিরুলের সঙ্গে স্ত্রী সায়মার কিডনি মিলে যায়। এ সংবাদ পেয়ে সায়মা হাসিমুখে স্বামীকে বাঁচাতে নিজের একটি কিডনি দেন।
গত ৫ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালে তাদের কিডনি প্রতিস্থাপনের অস্ত্রোপচার করা হয়। বর্তমানে হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে (আইসিসিইউ) চিকিৎসাধীন আছেন জহিরুল। আর সায়মা জাহানকে গত শনিবার হাসপাতাল থেকে ছুটি দেওয়া হয়। বর্তমানে তিনি রামপুরা এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় কোয়ারেন্টাইনে আছেন।
ভাবীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে জহিরুল ইসলামের ছোট ভাই পুলিশের (এসআই) আশিকুল হক বলেন, ‘আমরা ভাই হয়ে যা করতে পারিনি, ভাবী তা পেরেছেন। তাকে কৃতজ্ঞতা জানানোর কোন ভাষা নেই। মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করি, তিনি যেন উভয়কেই সুস্থ করে তোলেন। আপনাদের কাছেও দোয়া চাই।’
সায়মা জাহান সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি আমার স্বামী-সন্তান ও সংসারকে জীবনের চেয়েও ভালোবাসি। তাই আমি স্বামীকে বাঁচাতে আমি নিজের ইচ্ছায় কিডনি দিয়েছি। এখন বাঁচলে দুজন একসঙ্গে বাঁচব আর মরলেও একসঙ্গেই মরব।’
এমন ঘটনায় হতবাক এলাকার লোকজনও। উপজেলার নারানদিয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আবদুল কুদ্দুস বেপারী বলেন, সত্যিই এটি স্বামীর প্রতি স্ত্রীর ভালোবাসার এক অনন্য উদাহরণ। পরিবারের জন্য এমন ত্যাগ ও দৃষ্টান্তমূলক কাজ সব নারী করতে পারে না। আমি তাদের মঙ্গল কামনা করি