নববর্ষের বিশেষ কলাম : নুসরাত জাহান কচি
বাংলা নববর্ষে পুরনো বছরের ‘গ্লানি’ মুছে দিয়ে, নতুন বছরকে স্বাগত জানিয়ে বাঙালি-জীবনে ‘নতুনের , চেতনায় বাজায় এক মিলন মেলা।
বাঙালির সবচেয়ে বড় উৎসব হলো বাংলা নববর্ষ।ধর্ম বর্ণ সকলেই এই উৎসবের মাধ্যমে বাঙালি তার নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সঙ্গে ভালোবাসার বন্ধন স্থাপন করে এবংবিবেক সত্তার পরিচয়কে নতুন তাৎপর্যে উপলব্ধি করে।
মূল কথা হলো বাংলা নববর্ষ একদা বাঙালির জাতীয়তাবাদী চেতনাকে শানিত করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিলো, যার ফলে তাদের স্বাধিকার সংগ্রাম বেগবান হয় এবং মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ অর্জন সম্ভাবিত হয়। নববর্ষ কেবল বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বাঙালি তার জাতীয়তাবাদী চেতনায় শক্তি সঞ্চয় করে এবং নিজেদের আত্মপরিচয় ও শেকড়ের সন্ধানে খুঁজে । শুধু তাই নয়, বাংলা নববর্ষের মাধ্যমে বাঙালির আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনেও সঞ্চারিত হয়,
নববর্ষ এলে উৎসবের আমেজে আর নতুনের আবাহনে সমগ্র জাতি জেগে ওঠে। কিসের গ্রাম আর কিসের কী শহর সবজায়গাতেই প্রবাহিত হয় আনন্দের জয়গান।
-গীতিকা’র কবি নজরুল ইসলাম নববর্ষের নবসাজ দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেছিলেন : ‘আইলো নতুন বছর লইয়া নবসাজ,★কুঞ্জে ডাকে কোকিল★কেকা বনে গন্ধরাজ★’ আজো বাঙালি জাতির মনে গেথে আছে সেই কথাগুলো, লোককবি নবসাজে যে নতুন বছরের আগমন দেখতে পেয়েছিলেন, তা বাংলায় ছিলো নববর্ষ। এই নববর্ষ কীভাবে এলো সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে চোখ দিতে হতে ইতিহাসেরপাতায়।
ভারত-তত্ববীদ * আল-বেরুনির *কিতাব উল হিন্দ’-এ রচনাকাল আনুমানিক ১০৩০ খ্রিষ্টাব্দ, ভারতবর্ষে প্রচলিত যেসব অব্দের শ্রীহর্ষাব্দ, বিক্রমাব্দ, শকাব্দ, বলভাব্দ ও গুপ্তাব্দ,নাম উল্লেখ করেছেন, তাতে বঙ্গাব্দ নেই। বঙ্গাব্দ চালু হয় এর অনেক পরে, ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দে, সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে। ঐতিহাসিক আবুল ফজলের ‘আইন ই আকবরী’ সাক্ষ্য দিচ্ছে :
‘আকবর বেশ কিছুদিন ধরে হিন্দুস্থানের বিভিন্ন অঞ্চলে দিন গণনার সমস্যাকে সহজ করে তোলার জন্য একটি নতুন বৎসর ও মাস গণনা পদ্ধতি চালু করতে ইচ্ছা প্রকাশ করে।
আমীর ফতই উল্লাহ শিরাজির প্রচেষ্টায় এই নতুন অব্দের প্রচলন হলো। আকবরের সিংহাসনে আরোহণের ২৫ দিন গত হলে, অর্থাৎ বুধবার, ২৮শে রবি-উস-সানি ১১ই মার্চ ১৫৫৬ তারিখে ভুবন আলোককারী ‘নতুন বর্ষের’ শুরু হয়েছিলো। এ দিনটি ছিলো পারসিক বছরের নওরোজ, ১লা ফরওরদিন, বিশ্বাস অনুযায়ী ঐদিন ১১ই মার্চ সূর্য মেষ রাশিতে প্রবেশ করতো।’
সম্রাট আকবর হিজরি সন অনুযায়ী খাজনা তুলতে গিয়ে দেখেন ফসল তোলার সময়ের সঙ্গে মিল রাখা কষ্টকর হচ্ছে। এজন্য তিনি হিজরি সনকে ভিত্তিমূল ধরে সৌরনিয়মে বছর গণনা শুরু করেন, প্রবর্তন করেন বাংলা সনের। তিনি চন্দ্রমাসগুলোকে পরিণত করেন সৌরমাসে। আকবর প্রবর্তিত এই সনের তারিখ-ই-ইলাহি আদর্শে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা, দাক্ষিণাত্য ও বোম্বাই প্রদেশে আমলি, বিলায়তি ও বিভিন্ন ফসলি সন চালু হয়েছিলো। অনেকে শশাঙ্ক ও হোসেন শাহের আমলে বাংলা সন প্রচলনের কথা বললেও তা ঐতিহাসিকদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয় নি। ফলে বাংলা সন প্রবর্তনের মুকুট তারা সম্রাট আকবরের মাথায়ই পরিয়েছেন।
সময়ের বিবর্তনে বাংলা সন-তারিখের হিসাবে কিছু সমস্যা দেখা দেয়। ১৯৫২ সালে ড. মেঘনাদ সাহা জ্যোতির্বিজ্ঞানের বাংলাসহ বিভিন্ন বর্ষপঞ্জির আমূল সংস্কারের জন্য কতগুলো প্রস্তাবনা তুলে ধরেন। তাঁর সেই প্রস্তাবনার উপর ভিত্তি করে ১৯৬৪ সালে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে গঠিত কমিটি বাংলা বর্ষপঞ্জি সংস্কার করেন। স্বাধীনতার পর সাবেক প্রধান মন্ত্রী, তাজউদ্দীন আহমদ ও বাংলাদেশের স্থপতি যার নেতৃত্বে স্বাধীনতা পেয়েছে বাংলাদেশ সেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অফিসিয়ালি বাংলায় নোট লেখা ও বাংলায় স্বাক্ষর এবং তারিখ প্রদান প্রথা চালু করেন। ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশ সরকার সকল কাজকর্মে ইংরেজি সন-তারিখের পাশাপাশি বাংলা সন-তারিখ লেখার ঘোষণা দেন। পরে লিপ ইয়ারসহ কিছু বিষয়ে জটিলতা সৃষ্টি হলে বাংলা একাডেমি ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে তা সমাধান করা হয়। ১৯৯৫ সালের ১৯ শে আগস্ট সরকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে, প্রতি বছর ১লা বৈশাখ হবে ১৪ই এপ্রিল। আর তারিখ পরিবর্তনের সময় হবে রাত ১২.০০টা আন্তর্জাতিক রীতি অনুযায়ী।
বাংলা নববর্ষ যেভাবেই অাসুক না কেন, এখন তা বাঙালির প্রাণের উৎসবে পরিণত হয়েছে। ১লা বৈশাখ এলেই সকল বাঙালির প্রাণ বাংলা নববর্ষ-বরণের আনন্দে আপনা-আপনি সবাই মনের আনন্দে নেচে ওঠে।
সম্রাট আকবর বাংলা নববর্ষের প্রচলন করলেও, নববর্ষ পালনের ইতিহাস বহু পুরনো। সর্বপ্রথম নববর্ষ পালিত হয় মেসোপটোমিয়ায়, নববর্ষ চালু হয় জুলিয়াস সিজারের সময় থেকে। রাশিয়া, চীন, ইরান ও স্পেনে নববর্ষ পালিত হতো ঘটা করে। মুসলিম শাসকদের হাত ধরে ইরানের নওরোজ ভারতবর্ষে আসে। মুঘল আমলে খুব জাঁকজমকপূর্ণভাবে নওরোজ উৎসব পালন করা হতো।নওরোজ উৎসবেই জাহাঙ্গীরের সঙ্গে নূরজাহানের প্রথম প্রেম বিনিময় হয়েছিলো।
সম্রাট আকবর বাংলা নববর্ষ চালু করেন বছরের নির্দিষ্ট সময় প্রজাদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করার জন্য। ফসল তুলে আনন্দের সঙ্গে খাজনা দেওয়া এবং মিষ্টি খাওয়ানোর সঙ্গে কালে কালে যুক্ত হয় ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক আচার-বিশ্বাস, রীতি-নীতি ও আনন্দ-বিনোদনের উপাদান। ধীরে ধীরে দিনটি হয়ে ওঠে শুভচিন্তা ও অনুভূতির দ্যোতক। লোকমেলা, হালখাতা, গাজনের গান, লাঠিখেলা, ঘোড়দৌড়, পুতুল নাচ, জারি-সারি-বাউল গান এসব যুক্ত হতে হতে নববর্ষ আজ বাঙালির অস্তিত্বের উৎসবে পরিণত হয়েছে।
নববর্ষের সঙ্গে অর্থনীতির গভীর যোগসূত্র থাকলেও, এর সাংস্কৃতিক আবেদন সুদূরপ্রসারী। সামাজিক উৎসব হিসেবে নববর্ষ পালন শুরু হয় উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে। ১৯৪৭-এর দেশভাগের পর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী নিজেদের শাসন পাকাপোক্ত করতে গিয়ে যতই বাঙালির ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির টুটি চেপে ধরেছে – ততই বাংলা নববর্ষ পরিণত হয়েছে বাঙালির শক্তি-সাহস, প্রেরণা ও উদ্দীপনার মূলমন্ত্ররূপে।
বর্তমানে বাংলা নববর্ষ খুব জাঁক-জমকপূর্ণ ও ব্যাপক পরিসরে পালিত হলেও পঞ্চাশের দশকে সেটা তেমন ছিলো না। তখন লেখক-শিল্পী মজলিস ও পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ নববর্ষ উপলক্ষ্যে ঘরোয়াভাবে আবৃত্তি, সংগীতানুষ্ঠান ও সাহিত্যসভা আয়োজন করতো। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’ গান দিয়ে বছরের প্রথম দিন সকালে নববর্ষের আবাহন শুরু হয় রমনার অশ্বত্থতলায়, এবং সেটা হয় ১৯৬৫ সালে। এরপর বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন ও জাতীয়তাবাদী
আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধের মর্মমূলে গভীর প্রেরণা ও শক্তি যুগিয়েছে বাংলা নববর্ষ। দেশ স্বাধীন হলে নববর্ষ পালনে আরও ব্যাপকতা আসে।
১৯৭২ সালে পহেলা বৈশাখকে জাতীয় পার্বণ হিসবে ঘোষণা করে। সরকার পরবর্তীকালে ছায়ানট ছাড়াও রাজধানীতে শিল্পীগোষ্ঠী, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, বাংলা একাডেমি, চারুকলা ইনস্টিটিউট, শিল্পকলা একাডেমি, নজরুল ইনস্টিটিউট, জাতীয় জাদুঘর, বুলবুল ললিতকলা একাডেমী, মুক্তিযিদ্ধ জাদুঘরসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন বাংলা নববর্ষকে মহাউৎসবে পরিণত করেছে। বর্তমানে পল্লির নিভৃত কুটির থেকে শুরু করে গ্রাম জেলা শহর, বিভাগীয় শহর ও রাজধানী শহরের সর্বত্র উছলে পড়ে বাংলা নববর্ষ পালনের আনন্দ। হাজারো শিল্পী নেচে-গেয়ে বর্ষবরণ করে। রাজধানীর শপিং মল এবং গ্রাম-শহরের বিপণি-বিতানগুলোতে ভিড় জমে, প্রচারমাধ্যমগুলো প্রচার করে বিচিত্র অনুষ্ঠান। সংবাদপত্র বের করে বিশেষ ক্রোড়পত্র। দেশজুড়ে মঙ্গল শোভাযাত্রা ছাড়াও আয়োজন করা হয় বিচিত্র সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। নতুন পোশাক আর বিচিত্র সাজে রাস্তায় নেমে আসে সকল বয়সের মানুষ। ঢাক-ঢোল আর তবলায় তালে তালে গাওয়া হয় বিভিন্ন ধরনের লোকসংগীত
আলপনায় সাজানো হয় চারিদিক পান্তা-ইলিশ আর মুড়ি- ভোজ আর বাউলের একতারার সুরে মনমাতানো পরিবেশ তৈরি হয় ।
নববর্ষে , সকলের উদার ও অসাম্প্রদায়িক অগ্রযাত্রাকে বারবার বাধাগ্রস্ত করেছে সাম্প্রদায়িক অপশক্তি। পাকিস্তান সরকার নানা ভাবে বাংলা নববর্ষ উদযাপনে বাধাসৃষ্টি করলেও, বাঙালি জাতিকে দমিয়ে রাখতে। পারেনি। ২০০১ সালের ১লা বৈশাখ রমনার বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলা চালিয়ে ১০ জনকে হত্যা ও আহত করা হয় অগণিত মানুষকে। কিন্তু তাতেও থামানো যায় নি বাঙালির প্রণের উৎসব। নববর্ষের অগ্রযাত্রা। বরং গ্রাম থেকে শহর, শহর থেকে প্রবাস, যেখানে বাঙালি আছে, সেখানেই পালিত হয় বাংলা নববর্ষ। বাঙালি-জীবনের সকল ক্ষেত্রে নববর্ষ আনে নতুন মেলবন্ধন
আবারো নতুন করে নতুন রূপে, এসেছে বাঙালির প্রাণের উৎসব বাংলা নববর্ষ। ১৪৩০, জাতি ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে দেশে এবং প্রবাসে অবস্থানরত সকলকে, দেশ বাংলা প্রতিদিন পরিবারের পক্ষ থেকে বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা