
মেহেদী হাসান বাবু(ব্যুরো প্রধান)গাইবান্ধা:
উপজেলা পর্যায়ে আদালত স্থানান্তর ফলপ্রসু হবে না বলে মতামত প্রদান করে অ্যাডঃ মাজহারুল ইসলাম সোহেল বলেন-উপজেলা পর্যায়ে আদালত স্থানান্তর করার সিদ্ধান্ত সামাজিক বিবেচনায় হয়তো সঠিক। কিন্তু প্রায়োগিক ও বাস্তবিকতায় উপজেলা পর্যায়ে আদালত স্থানান্তরে সফলতা আসবে না। ইতোপূর্বে ১৯৮৮ সালে সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ উপজেলা পর্যায়ে আদালত স্থানান্তর করেছিলেন এবং প্রান্তিক পর্যায়ে বিচার ব্যবস্থা নিয়ে গিয়েছিলেন। ফলশ্রুতিতে বিচার বিভাগ যেমন নষ্ট হয়, পাশাপাশি বিজ্ঞ আইনজীবী দের সম্মানও অনেকাংশে নিম্নগামী হতে ভূমিকা পালন করে। এরশাদ সরকারের আমলে জেলায় জেলায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন আইন কলেজের কার্যক্রম শুরু হয়। তখন সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ ভেবেছে বাড়ির পাশেই আইন কলেজ একটু এলএলবি টা পড়ে নেই। অনেকেই যেভাবেই হোক এলএলবি টা পাশ করে এবং ছলচাতুরী’র আশ্রয় নিয়ে বার কাউন্সিলের এনরোলমেন্ট করে ফেলেন। যার ফলে আইন পেশা তার ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলে। বিশ্বের ন্যায় এই দেশেও আইন পেশা ছিল রয়্যাল পেশা এবং বিজ্ঞ আইনজীবী গন ছিলেন সমাজের দর্পণ। ব্রিটিশ ভারতে ও পাকিস্তান সরকারের সময় সকল আন্দোলন সংগ্রামে আইনজীবী গন নেতৃত্ব প্রদানের মাধ্যমে সমাজের সম্মানীয় আসনে স্থান দখল করে রেখেছিলেন।কিন্তু জেলা শহরে আইন কলেজ গঠন করায়, বৃদ্ধ ও মধ্য বয়সে এসে আইন পেশায় যোগদান করা আইনজীবী গন আইন পেশা কে ধ্বংস করে ফেলেন। বৃদ্ধ বয়সে আসা আইনজীবী গন সবসময় রাজনীতি, কূটকৌশল ও ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে আইন পেশা কে নিম্নস্তরে ধাবিত করতে অনেকাংশে দায়ী।উপজেলা পর্যায়ে এখনো যেগুলো চৌকি আদালত আছে, তা খুব বেশি ফলপ্রসূ নয় এবং সেখানেও বিচার ব্যবস্থা সারা দেশের ন্যায়। এরশাদ সরকারের পতনের পরে উপজেলা পরিষদ পদ্ধতি বিলুপ্ত হলে ১৯৯১ সালে উপজেলা আদালতগুলোর প্রায় সকল আদালতই জেলা তে স্থানান্তর করা হয়। উপজেলা পর্যায়ে যখন আদালত ছিল তখন তা রাজনৈতিক নেতৃত্বের অযাচিত হস্তক্ষেপ, মাননীয় বিচারকদের অপর্যাপ্ত আবাসন ব্যবস্থা ও সুযোগ সুবিধার অপ্রতুলতা হেতু আরো কিছু অব্যক্ত অসুবিধার প্রেক্ষিতে প্রায় সকল আদালত উপজেলা হতে পুনঃরায় জেলায় স্থানান্তর করা হয়।বর্তমানে প্রায় সকল জেলায় জেলা জজ আদালত ও সিজিএম আদালতের জন্যে নতুন ভবন তৈরী হয়েছে। যে সকল জেলায় ভবন এখনো তৈরী সমাপ্ত হয় নাই, তা দ্রুত তৈরী করলে আবাসন সমস্যা আর থাকবে না। বাকী থাকবে মামলা জট কমিয়ে আনা, সেক্ষেত্রে পর্যাপ্ত সংখ্যক বিচারক নিয়োগ প্রদান করলে বিচারক সংকট অনেকাংশে কমিয়ে আসবে। সুতরাং, দ্রুত বিচার সমাপ্ত করতে মাননীয় বিচারকদের ঘাটতি আর থাকবে না। দ্রুত ও ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতে বিচারক ও আইনজীবী একটি পাখির দুইটি ডানা। পাখির একটি ডানা যদি আঘাতপ্রাপ্ত হয়, তবে পাখি কিন্তু উড়তে পারবে না। সুতরাং, বিচারকদের পাশাপাশি ন্যায়-বিচার দ্রুত নিষ্পত্তি করতে আইনজীবী দের দায়িত্বশীল হতে হবে। একটি মামলায় দুইটি পক্ষ থাকে, একটি পক্ষ হচ্ছে সরকারপক্ষ/রাষ্ট্রপক্ষ/বাদীপক্ষ/এজাহারকারীপক্ষ এবং অপরপক্ষ হচ্ছে বিবাদীপক্ষ/আসামীপক্ষ। বিবাদীপক্ষ অথবা আসামীপক্ষ যেহেতু বিচারপ্রার্থী মোয়াক্কেল নিজে নিয়োগ দেন, সুতরাং সম্পূর্ণ আন্তরিকভাবে সেই-সকল বিজ্ঞ আইনজীবী গন মোয়াক্কেল পক্ষে মামলা পরিচালনা করেন। অন্যপক্ষ হচ্ছে সরকারপক্ষ/রাষ্ট্রপক্ষ যেহেতু তাদের নিয়োগ হয় রাজনৈতিক বিবেচনায় এবং তাদের সম্মানী পর্যাপ্ত নয়, সুতরাং স্বল্প সময়ে প্রসিকিউশন পক্ষে দায়িত্ব পালন করবেন হেতু তাদের আন্তরিকতার কিছুটা ঘাটতি লক্ষণীয়।এক/এগারো সরকারের সময় স্থায়ী প্রসিকিউশন সার্ভিস চালু করার কাজ শুরু করতে অধ্যাদেশ প্রণয়ন করে, কিছুটা কাজ দৃশ্যমান হলেও পরবর্তীতে কোন এক অদৃষ্ট কারনেই হোক তা আর আলোর মুখ দেখে নাই। এখন সময় এসেছে আবারো নতুন করে শুরু করার। স্থায়ী প্রসিকিউশন সার্ভিস চালু করা এবং নিরপেক্ষতার সহিত জেলা পর্যায়ে দলমতের উর্ধ্বে উঠে স্থায়ী প্রসিকিউটর নিয়োগ দেওয়া। দেশের সকল আইনজীবী দের মোটিভেশন ট্রেনিং দিয়ে তাদের দায়িত্ববোধ কে জাগ্রত করতে হবে। পাশাপাশি বিচারবিভাগের জন্যে পৃথক সচিবালয় গঠন করতে হবে। জেলা আদালতের মাননীয় বিচারকদের নিয়োগ, বদলি ও প্রমোশন বিচার বিভাগীয় মন্ত্রণালয়ের অধীনে করতে হবে। মাননীয় প্রধান বিচারপতি, আপিল বিভাগের একজন মাননীয় বিচারপতি ও হাইকোর্ট বিভাগের একজন মাননীয় বিচারপতি তিন জন যৌথভাবে বিচার বিভাগের পৃথক মন্ত্রণালয়ের সকল কর্মকাণ্ড দেখভাল করবেন। সকলে প্রত্যাশা করছে উপজেলায় আদালত স্থানান্তর হলে সকল আদালত উপজেলা পর্যায়ে যাবে। কিন্তু বাস্তবতা তা নয়, শুধুমাত্র সিনিয়র সহকারী জজ ও সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট/আমলী আদালত শুধু যাবে। ঐ দুইটি আদালত ব্যতীত সকল আদালত কিন্তু জেলা তে থাকবেই, সুতরাং দুইটি আদালত ব্যতীত অবশিষ্ট আদালত সমূহ জেলায় থাকলে সেক্ষেত্রে আদালতের কার্যক্রম বিঘ্নিত হওয়া ছাড়া আর কিছুই হবে না। আইনের প্রয়োগ হচ্ছে, আমলী আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে মামলাটি বিচারের জন্য বিচারিক আদালতে প্রেরণ করেন। সেক্ষেত্রে উক্ত মামলাটিতেই আবার বিচারের জন্যে জেলা তেই আসতে হবে। ফলশ্রুতিতে উপজেলায় আদালত স্থানান্তর হলে শুধুমাত্র গোঁজামিল আদালতে রুপান্তরিত হবে।সুতরাং উপজেলা পর্যায়ে আদালত স্থানান্তরের প্রয়োজন নেই। শুধুমাত্র স্বাধীন, নিরপেক্ষভাবে ও যথাযথ আইনের চর্চা করলেই মাননীয় বিচারক ও বিজ্ঞ আইনজীবী গনের সম্মিলিত প্রয়াসে ন্যায় বিচার নিশ্চিত করা সম্ভব।