• ঢাকা, বাংলাদেশ শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৭:০৯ অপরাহ্ন
  • [কনভাটার]

ভূতুরে আংটি / মধ্যনগরের কৃতি সন্তান মাঈন উদ্দিন

নুসরাত কচি বিশেষ প্রতিবেদক / ৩৮৪ জন দেখেছেন
আপডেটঃ মঙ্গলবার, ১৬ মে, ২০২৩

বিশেষ প্রতিবেদক নুসরাত কচি

সম্ভ্রান্ত মুসলিম দম্পতি ‘মরহুম আব্দুল আলী ও মোছাঃ চাঁনবানু বেগম’ এর কনিষ্ঠ সন্তান মাঈন উদ্দিন, ১৯৮৯ সালে ২২ এপ্রিল সুনামগঞ্জ জেলা    মধ্যনগর উপজেলার বংশীকুন্ডাস্থ দাতিয়া পাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

উপজেলার খ্যাতিমান শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ‘মহিষখলা দাখিল মাদ্রাসা’ থেকে দাখিল এবং ‘চট্রগ্রাম ক্যান্টনম্যান্ট পাবলিক কলেজ’ থেকে ‘উচ্চমাধ্যমিক’ পাশ করেন।

বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কর্মরত আছেন। তারি লেখা

আককের বিশেষ কলাম

ভূতরে আংটি
এককান দুইকান করে সুরুজ আলি, আর কুলসুমের পিরিতের খবরটা পাড়ার সকলের মাঝে জানা-জানি হয়ে গেল।
সুরুজ আলি কুলসুমদের বাড়ীর কাজের লোক, বিগত পাঁচ বছর ধরে সে এ বাড়িতে কামলা খাটছে। কুলসুমের সাথে তার একটা প্রনয় ঘটিত ব্যাপার আছে বলেই সে এতদিন ধরে খেটে যাচ্ছে। নইলে তার একার পেট নিয়ে পড়ে থাকার কি অর্থ?
প্রস্তাব দিয়ে যে বিয়ে করাবে এমন লোক সুরুজের নেই বললেই চলে। সেক্ষেত্রে লোক মুখের কথাগুলো তার বিনা পয়সার ঘটক। পাড়ায় পাড়ায় রাষ্ট্র হওয়া খবরটাতে যে তার কিঞ্চিত হাত-ইশারা রয়েছে! এটা স্পষ্টত বুঝা না গেলেও একেবারে ধারনার বাইরে নয়। চলনে বলনে একটা জামাই জামাই ভাব সুরুজের। তবে কুলসুমের অবস্থা পুরাই বিপরিত। লজ্জায় ঘরকুনো বেচারির নাওয়া খাওয়াই যেন ঠিকমত হচ্ছেনা। সারাদিন আন্দর ঘরে চুপচাপ শুয়ে থেকে দিনানিপাত।
অতঃপর তাঁদের বিবাহ হইলো।
বিয়ের পর জামাইকে তার বিলাত ফেরত মামাশ্বশুর একখানা সোনার আংটি উপহার দিলেন। সুরুজ আলির শরীরে যেন পরশ পাথরের ছোঁয়া লাগলো! খুশিতে সে ততক্ষণাৎ উপস্থিত সাবাই কদমবুসি করলো। কদমবুসি করার সময় দেখা গেল তার দু চোখে চিক চিক করছে আনন্দ অশ্রু।
আংটি খানা দেখতে বেশ চমৎকার, মাঝ খানে লাল-নীল পাথর খচিত। সত্যিই বড়ই সৌন্দর্য্য। ইশ! বিয়া না করলে এমন একটা সোনার জিনিস, সারা জীবনেও কপালে জুটতো না। এটা ভেবে বড্ড আফসোস হলো তার।
তখন থেকে বউয়ের প্রতি ভালবাসাটা আরো বহুগুণে বেড়ে গেলো।
শুধু ভালবাসা দিয়ে কি আর সংসার চলে? সুরুজ খেটে খাওয়া মানুষ। ক্ষেত খামারে কাজ না করলে যে তার পেটে ভাত পরবেনা! বিয়ার পর তাই কাজের মাত্রা আরো বৃদ্ধি পেল। তবে সে ছিল সৌখিনদার প্রকৃতির মানুষ। কাজের  শেষে, গা-গতর পরিস্কার করে। বউয়ের থেকে একটু গন্ধরাজ তৈল মাথায় দিয়া আংটি খানা হাতে পরে হেঁটে বেড়ায়। আংটি খানা হাতে দিলে তার মাঝে একটা ভাব চলে আসে। তখন সে সকলের সাথে সুমিষ্ট ব্যবহার করে। আর কথায় কথায় উপস্থিত সবাইকে আংটিখানা দেখায়া বলে, ‘দেখেন কত্ত দামি আংটি! জানেন? এটা আমার মামা শ্বশুর সেই বিলাত থ্যাইকা অর্ডার দিয়া আমার জইন্যে বানায়া আনছে।’
কথার মাঝে সে দুই চারটা মিথ্যা কথাও ডুকায়া দেয়। আর সেই সুযোগে কিছু লোক সুরুজের কাছে পান-চুরুটের দাবি করে, সুরুজও সেই দাবি মানিয়া লয় খুশি মনে। নিজেকে তখন অনেক বড় মনে হয় তার।
‘‘একখানা আংটি যেন তার জীবনটা ই বদলায়ে দিলো।’’
একদিন সন্ধায় সুরুজ একা একা বাজার থেকে বাড়ি ফিরছিল। পড়ার মোরে একটা হিজল গাছ আছে, তার পাশ দিয়া রাস্তা। এখানে এসেই সে থমকে দাড়ালো, কে জেন অদৃশ্য থেকে ছড়া কেটে কেটে কথা বলছে!
    ‘‘বিলাত থ্যাইকা আয়ছি আমি
      বিলাত আমার গাঁও
      আমারে করিলে যতন
      পাবে যাহা চাও’’
এখানটায় নাকি এককালে ভূতের আস্থানা ছিল! সেই ভূতেরা মাছ খাইতো, মানে শুধু মাছের মাথা! সকাল বেলা মাথাবিহীন মাছ পরে থাকতো। এসব শুনা কথা, কেউ শুনেছে তার বাবার কাছে, কেউ শুনেছে তার দাদার কাছে। তবে কেউ নিজে দেখেনি। অবশ্য এখন আর সেই দিন নাই। গ্রামে বিদ্যুৎ এসেছে রাস্তাঘাটে মাটি কাটা হইছে, খালে খালে ব্রিজ হইছে, ছেলে-পুলেরা এখন রাত নয়-দশটা পর্যন্ত ব্রিজে বসে আড্ডা মারে। শুধু এই জায়গাটা একটু নির্জন। সুরুজ তিন বার বিসমিল্লাহ্ বলে বুকে থুথু দিলো।
কথাগুলো সে পর পর দুই বার শুনলো। বিলাতি বলতে তার মনে একটা খটকা লাগলো, সে ততক্ষনাত ভাবলো, ‘এই আংটিটার সাথেই একমাত্র বিলাত কথাটার সম্পর্ক। আর তো কিছুই দেখিনা।’
স্বর্ণের আংটি কি কখনো কথা বলতে পারে? তার মনে একটা সন্দেহ ডুকে গেলো। হাতের আংটি টা খুলে নাড়া-চাড়া করে, আবার হাতে মুঠোয় নিলো। একটু কি গরম টরম লাগে কিনা দেখলো। কিছুই না। ভায়ে ভায়ে সে বাড়ির দিকে হাটতে লাগলো, না এরপর আর কোন সারা শব্দ হলো না।
বাড়ি এসেও তার মন থেকে বিষয়টা পুরোপুরি সরাতে পারছেনা, বউকে ব্যপারটা বলবে কি না ভেবে, আর বললো না। বউ আবার কি না কি মনে করে। পাছে কাউকে বলেও দিতে দিলে, তখন লোকেরা হাসাহাসি করতে পারে! বিষয়টা তার আরো পরখ করা চাই।
সেই রাতে সুরুজ আলি স্বপ্নে দেখলো আংটি তার সাথে কথা বলছে, ‘এই সুরুজ আমি তোর হাতের আংটি বলছি, আমি কোন যেনতেন আংটি নই! বিলাতের অনেক রাজা-বাদশা আমাকে ব্যবহার করেছে, যত্ন-তাবেদার করেছে, সিন্দুকে তুলে রেখেছে। তুই বড়ই সৌভাগ্যবান যে আমায় পেয়েছিস। তুই আমারে লইয়া যেখানে সেখানে যাস! মিথ্যা কথা বলস! ঠিকঠাক না চললে বলে দিলাম, তোর অমঙ্গল হবে। বড্ড অমঙ্গল।’
অমঙ্গল কথাটা শুনেই গলা শুকিয়ে এলো সুরুজের, ঘুম থেকে ধর-মর করে উঠে বসে পড়লো। ঠাহর পেয়ে কুলসুমও উঠলো সাথে সাথে।
‘কি হইলো তোমার, এরুম হাঁস-ফাঁস করতাছো কেরে?’
‘একটা খারপ স্বপ্ন দেখছি।’
‘কিমুন খারপ?’
‘স্বপ্নের কথা রাইতের বেলা কইতে নাই।’ কুলসুম আর জোর করলো না, বিছনা উঠে এক গ্লাস পানি এনে দিলো। পানি খেয়ে দুজনে শুয়ে পরলো, তবে প্রাণহীন একটা আংটি সুরুজকে তুই তুকারি করে কথা বললো! এটা ভেবে কিছুটা মন খারাপ হলো। বাকি রাতটা তাঁর আর ঘুম হলোনা।
পরদিন সকালে সুরুজের বউ স্বপ্নের কথা জানতে চাইলো,
‘কি দেখছিলা খবে?’ সুরুজ সাথে সাথে একটা মিথ্যা কথা বানায়া ফেললো, ‘খোয়াবে দেখছি তোমার মামুর লগে আমিও বিদেশ যাইতাছি, বিমান খালি সাত আসমানের উপ্রে উঠছে। এমুন সময়ে ডেরাইভার কইতাছে বিমানে এক ফুডাও তেল নাই! সবাই লাপ দেও। লাপ লাপ, লাপ, লাপ… এহন কি করুম কও? লুঙ্গিডা কাছা মাইরা দিছি একটা ফাল।’ কুলসুম এই আজগুবি কথা আর শুনতে চাইলো না।
অনেক খুঁজাখুঁজি করে শাপলা ফুলের ন্যায় ছড়িয়ে যাওয়া দাঁত মাজার একটা ব্রাশ জোগাড় করলো সুরুজ আলি। তারপর সাবান দিয়ে ঘষামাজা করে ফেনা তুলে দাঁত ব্রাশ করার মত আংটিটা পরিস্কার করলো। ধোয়ে মুছে বউকে দিয়া বললো,
‘এটা যত্ন করে টাঙ্কে তুলে রাহ। সারাদিন কাম-কাইজ করি, আংটি পিন্দার সময় নাই। তাছাড়া গরীব মাইনষ্যের হাতে আংটি দেখলে লোকে হিংসা করে।’ হঠাৎ করে আংটি খানা খুলে ফেলাতে কুলসুম কিছুটা অবাক হলো! আবার ভাবলো, ‘কথাডা ঠিহই। পুরুষ মাইষ্যের আবার স্বইন্নের জেওর পরন লাগে নি? সারাদিন থাহে মাঠে-ঘাটে, এতোদিনে যে হারায়া ফালায় নাই এই ঢের।’
ঝকমকে পরিষ্কার আংটি খানা দেখে, তার মনে একটা ফন্দি ঠেকলো। বিয়ার সময় সেই যে একজোড় রুপার চুড়ি আরেকটা গলার চেইন দিসিলো, এহন পর্যন্ত সুরুজ আর কিছুই দেয়নি তাকে। ‘এইডা দিয়া একজোড়া কানের দুল বানালে কেমন হয়?’ সে মনে মনে বলতে লাগলো, ‘এবার বাপের বাড়ি গেলে লুকায়া আংটিটা নিয়া যামু, মারে বইল্যা আংটিটা ভাইঙ্গা একজোড়া কানের দুল বানামু। সেই সোনার দুল কানে দিয়া সুরুজকে পা ছুইয়া সালাম করলে, খুশিতে স্বামী আর কিছুই কইবো না। এই বিশ্বাস তার আছে, কারন সুরুজ তাকে অনেক ভালবাসে।
যেই চিন্তা সেই কাজ।
কুলসুম বাপের বাড়ি যাবে, সুরুজ নিজে তারে লইয়া গেল। তার হাতে কাজের চাপ থাকায়, দু-চার দিন থেকে বাড়ী যেতে চাইলো। কুলসুম জানালো, সে আরে কয়দিন বাপের বাড়ীতে থাকতে চায়? এতে সুরুজ আর দ্বিমত করলো না। কুলসুম কে রেখেই ফিরে গেল। যাবার আগে কুলসুম বলে দিল, এক সাপ্তা পরে এসে যেন তাকে নিয়ে যায়।
স্বামী চলে যাবার পর কুলসুম তার মাকে মনের কথাটি খুলে বললো, ‘মা তোমাদের জামাই কইছে তোমরা আমারে এই আংটি টা ভাইঙ্গা একজোড়া কানের জেওর বানায়া দিতে। তার কাছে এতো ট্যাহা নাই আবার যদি ভানিয়া সোনাচুরি করে! তুমি যেমনে পার এইডা বানায়া দেও।’
একমাত্র মেয়ের এমন আবদার, মা না রেখে যাবে কই। তাছাড়া তাদের গ্রামেই স্বর্ণাকার আছে, দুইটা মুরগি বেঁচলে এ কাজটা তিনি সহজেই করে দিতে পারেন। মা রাজি।
আংটি টা এখন মতি স্বর্ণকারের দোকানে। স্বর্ণাকার মতি মিয়া এক সাপ্তা সময় নিল, হাতে অনেক কাজ এক সাপ্তার বেশিও লাগতে পারে। গ্রামে একটাই ভানিয়ার দোকান, অাগত্য কুলসুমকে রাজি হতে হলো।
মতি ভানিয়া একা একাই কাজ করে, মাঝে মধ্যে তার ছেলে পরশ একটু আদটু কাজ শিখে।
সেদিন দুপুরবেলা শরীরটা অলস লাগায় দোকানে বসার জায়গাটাতে একটু হেলান দিলো। চোখে ক্ষানিক তন্দ্রা ভাব এলো, এমনি কোথা থেকে যেন আওয়াজ আসছে…
  ‘‘ও ভাই ভানিয়া
   একটু এদিক পানে চাও
   বিলাত থ্যাইকা আয়ছি আমি
   বিলাত আমার গাঁও
   আগুনে জ্বালায়া সোনা
   পানিতে নিভাও
   ঘষিয়া মাজিয়া পরে
   জেওর বানাও
   সেই জেওর বিকিয়া
   তুমি যত কড়ি পাও
   তার চেয় ঢের দেবো
   যদি তুমি চাও’’
ছড়াটা শুনে মতিমিয়া হকচকিত হয়ে উঠে বসলো, এমন তো আগে কখনো হয়নি।
তবে কবিতার ছড়াটা তার মনে ধরলো।
সাত-পাঁচ ভেবে চিন্তে কাজে মন দেবার চেষ্টা করলো, কিন্তু সেই ছড়াটাই ঘুরেফিরে কানে বাজছে! ‘ও ভাই ভানিয়া…’ যেন এক মধুর কন্ঠে তাকে ডাকছে? তার কেমন যেন উদাস উদাস লাগছে! কাজে আর মন বসলো না, শেষে মতি মিয়া দোকান বন্ধ করে বাড়ি চলে গেল।
রাতে স্বপ্নে দেখলো তার দোকানে, মহা মূল্যবান হীরা-জওহর খচিত একটি তরবারি বিক্রি করতে এসেছে একজন মুসাফির লোক। দাম খুব বেশি চাওয়ায় মতি মিয়া রাখলো না সেটা। আর অচিনা লোকের বিশ্বাস কি? তাছাড়া হীরা-জহরত জিনিসগুলে সে কোন দিন চৌক্ষ্যে দেখেনি! শুধু নামই শুনেছে। স্বপ্নে দেখা হীরা-জহরত গুলোর উজ্জল আলোক রশ্মি যেন তার চোখ জুরে লেগে আছে এখনো। স্বপ্নটা তাড়াতাড়ি ভেঙ্গে যাওয়ায়, তার খুব আফসোস লাগলো। তবে কুলসুমের আংটির সাথে, স্বপ্নের তরবারির কোথাও যেন একটা মিল আছে। মতি মিয়া এবার ধান্ধায় পরে গেল! ‘অদৃশ্য ছড়া, স্বপ্ন, এসব কি হচ্ছে তার সাথে?’
পরদিন সকালবেলা দোকান খুলেই আংটি খানা হাতে নিল সে, রাতে স্বপ্নে হীরা-জহরত গুলোর সাথে হুবুহু মিল এই আংটির। তবে কি এগুলাই সেই মহা মূল্যবান বিলাতি হীরা-জহরত? মতি মিয়া ভাবে এই পাথর গুলোই মনে হয় হীরা-মতি। এমন সুন্দর আংটি মতি মিয়া জীবনেও দেখেনি, আহা বড়ই সুন্দর্য! মতি আংটি নাড়া-চাড়া করে হাতের আঙ্গুলে দেয়, কিন্তু তার পুরষ্ট আঙ্গুলের কোনটাতেই লাগেনা সেই আংটি! তাতে কি? সে নিজে ভাইন্যা, কাইট্টা জুড়া দিয়া একটু বড় করলেই পড়া যাবে। এটা সে রেখে দিবে সিদ্ধান্ত নিলো। প্রয়োজনে আরো দুই রতি বেশি দিয়া কুলসুম কে কানের ফুল বানায়া দেবো।
তবে কাজটা কুলসুমকে জানায়া করবে কি না, দ্বিধায় পরে গেল সে, ‘এমন সুন্দর একটা জিনিস না বলে মেরে দেই কেমন করে? আবার বলতে গেলে যদি রাজি না হয়।’ মতি মিয়া সরল মনের মানুষ, এমন কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নিতে ভেবে ভেবে সাপ্তা পার হয়ে গেল!
এদিকে কুলসুম আর তার মা, যথাসময়ে দোকানে এসে হাজির। মতি মিয়া তাদের কি বুঝাবে ঠিক ভেবে পাচ্ছে না। আবার তার কাছে বানানো কোন কানফুলও নাই, যে এক জোড়া গছায়া দিবে। কুলসুম আর তার মা, তাকে অনেক অনয় বিনয় করে বললো, ‘মতিভাই দয়া কইরা আজকাই আংটিটা ভাইঙ্গা একজোড়া কানের ফুল বানায়া দেও। লাগলে আরো কুড়ি টাকা বেশি দেবো। মেয়ের অনেক দিনের শখ তবু পুরা হোক।’
এদিকে মতিমিয়াও তাদের এক সাপ্তার সময় দিয়েছিল। মতি এক কথার মানুষ। এটা গ্রামের সকলে জানে, আজ তাহলে সেটা মিথ্যে হয়ে যায়।
অবশেষে মতি মিয়া তাদের সামনেই আংটি খানা আগুনে পুড়া দিল। এতে তার বড্ড মায়া এবং আফসোস লাগলো ঠিক স্বপ্নের মতই।
কানের ফুল দুটি যেন লাউ ফুলের মত হলো। সে যেমনই হোক স্বর্নের তো, এতেই কুলসুমের তৃপ্তি। ফুল দুটি কানে দিয়া, আয়না লইয়া কুলসুম অনেক্ষণ ধরে মাথা আচরাইয়া সিঁথি করে চুল বাঁধলো, চোখে একটু কাজল ও দিল। বিয়ের পর আর তেমন করে সাঁজা হয় না! আজ তাকে যে কত সন্দর লাগছে, আয়নায় নিজেকে দেখে তার নিজেরি খুব লজ্জা লাগছে!
ইশ সুরুজ আলি যদি তাকে এই সাঁজে দেখতো? তাহলে যে কি খুশি হইতো বলার মত না। কুলসুম মনে মনে চিন্তা করলো কালই চলে যাবে, স্বামীর জন্য তার একটু মায়া হলো। কাজের চাপে বেচারা আসতেও পারছেনা। কানের দুল দুটি দেখে না জানি কি বলে এই ভেবে কিছুটা চিন্তিতও হলো।
গুণে গুণে দুই সাপ্তাহ গত হয়ে গেল, কিন্তু সুরুজ আলির কোন খবর নাই! কুলসুমের অস্থিরতা দেখে, শেষে তার বাপ তাকে লইয়া রওয়ানা দিল।
বাড়ি এসে দেখে সুরুজের অবস্থা মর মর! কি যানি এক জ্বরে সুরুজ আলির প্রাণ উষ্টাগত প্রায়।
ঘর-দোয়ারের একি হাল, এ কদিনে বাড়ি জঙ্গল হইয় গেছে।
তবে সব ছেড়ে আগে স্বামীর সেবা-যত্নে মন দিলো সে।
বউয়ের আদর যত্নে ধীরে ধীরে সেরে উঠতে লাগলো সুরুজ। কুলসুমের রান্নাবাড়া’র সময়টাতে সুরুজ মাদুর পেতে বারান্দায় শুয়ে থাকে। অসুখের সময় সুরুজ ভেবেছে আংটি টার কথা, স্বপ্নের কথা সব কুলসুম কে খুলে বলবে। শুধু তাই না আংটিটা এখনো মাঝেমধ্যে তাকে ভয় দেখায়ে চলছে। সুরুজ বসে বসে ভাবছে এখনি কুলসুমকে ডেকে বলি, তাকে আশেপাশে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। ঠিক তখনি নিরবতা ভেঙ্গে তার কানে আওয়াজ এলো…
      ‘‘সোনার ফুল মাটির ফুল
        হাতের আংটি কানের দুল
        আমরা দুটি লাউ ফুল
        ফুলগুলি ঘরে তুল’’
সুরুজের মনে হলো, তার ভূতেরর আংটি আর ঘরে নাই। ঘর ছেড়ে নিশ্চই বাইরে বেরিয়েছে এবার।
কুলসুম গেছিলো ঘাটে পানি আনতে, আসার সাথে সাথেই তাকে ডেকে বললো, ‘কুলসুম তোমাকে যে আমার আংটি টা দিসিলাম, এটা কই?’ স্বামী আংটির কথা জানতে চাওয়াতে কুলসুম একটু ইতস্ত বোধ করলো, ততক্ষণাত কি জবাব দিবে বুঝে উঠতে পারছে না। তার ধারণা, সুরুজ হয়তো জেনে গেছে।
কথা কাটানো জন্য কুলসুম উত্তর দিলো, ‘আংটি তো তোমার সামনেই টাঙ্কে ভইরা থইছি।’
সুরুজ ফের বললো, ‘খুইল্যা দেখনা আছেনি?’
‘এখন পারবো না, আমার কাম আছে।’ অসুস্থ সুরুজ আর জোর খাটালো না।
স্বামীর সেবা-যত্ন, আর সংসারের কাম-কাইজে, নতুন কানেরদুল দুটি যে কোথায় রাখছে এটা এখন আর মনে পরছে কুলসুমের! সারা ঘরময় তন্ন তন্ন করে খুঁজছে, কোথাও মিলছে না। হায় হায় এখন কি করি। স্বামীর কাছে কি জবাব দিবে ভেবে পাচ্ছে না কুলসুম।
বউয়ের এই পেরেশানি দেখে সুরুজ বুঝতে পারলো, আংটি খানা গচ্ছা গেছে! তবে এ নিয়ে তার কোন অনুরাগ নাই। সুরুজের ধারণা এটা ভূতের আংটি, আর সেই আংটির জন্যেই তার এই অবস্থা। আপদ দূর হইছে এই ভালো, শুকুর-আলহামদুলিল্লাহ্।
কুলসুম কে ডেকে বললো,
‘আমি জানি আংটি টা তুমি খুঁজে পাইতাছো না।’ সুরুজের কথা শুনে কুলসুম কোন উত্তর দেয় না। জিঞ্জাসু চোখে হা করে চেয়ে থাকে, স্বামী তার আর কিছু বলবে কি না? তার এই চাহনি বলে দেয়, ‘তাহলে গেল কই?’
এই মূহুর্তে সে কিছুই বুঝেতেছে না কি বলবে। সুরুজ আবার বলে,
‘আংটি চলে গেছে, তার সাথে আমার কথা হইছে। আমি তারে তার দেশে চলে যাইতে কইছি।’ আংটি মানুষের সাথে কথা বলে, এটা শুনে কুলসুম আসমান থ্যাইকা মাটিতে পড়লো।
‘কি কও তুমি?’
‘হ ঠিকই। এটা ভূতের আংটি, এই আংটি হাতে দিলে আমার মাথা ঠিক থাকেনা, হাছা-মিছা কথা কই! এর জন্যই আমার এই অবস্থা।’ তবে কুলসুম দেখছে, স্বামীর মাথা এখনই খারাপ। আগে ভালই ছিল। আংটি হারাইছে বলেই কি তার মাথা খারাপ, নাকি অসুখে? এই প্রশ্ন কুলসুমের মাথায় চরকির মত ঘুরপাক খেতে থাকে।
আংটি ভাইঙ্গা আমি কানের দুল বানাইছি, এই কথাটি শতবার বলেও সুরুজকে বিশ্বাস করাতে পারেনি কুলসুম।
বরং প্রায়ই তাকে দেখা যায়, একা একা কথা বলতেছে…
     ‘‘বিলাত থ্যাইকা আয়ছো তুমি
       বিলাত ফিরা যাও
       ভুল তিরুটি করে থাকলে
       ক্ষেমা করে দাও’’
     ‘‘সোনার ফুল মাটির ফুল
       হাতের আংটি কানের দুল
       আমরা দুটি লাউ ফুল
       সব সোনারা ঘরে ফিরে
       আমাদের নাই কুল’’


আপনার মতামত লিখুন :

মতামত লিখুন

এই বিষয়ের আরও খবর

এইমাত্র পাওয়া

No video found!

April 2024
S S M T W T F
 123456
78910111213
14151617181920
21222324252627
28293031  

No video found!