রিপন কান্তি গুণ, নেত্রকোনা জেলা প্রতিনিধি;
নেত্রকোনার দুর্গাপুরের ব্রিটিশবিরোধী ও ঐতিহাসিক টংক আন্দোলন তথা হাজং বিদ্রোহের একমাত্র সংগ্রামী বিপ্লবী নারী নেতা কমরেড কুমুদিনী হাজং [৯২] আর নেই।
আজ [২৩ মার্চ] শনিবার দুপুরে বার্ধক্য জনিত কারনে তিনি নিজ বাড়ি নেত্রকোনার সীমান্তবর্তী উপজেলার দুর্গাপুরে বহেরাত
গ্রামে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।কুমুদিনী হাজংয়ের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন, তাঁর স্বজন বিরিশিরি ক্ষুদ্র নৃ–গোষ্ঠীর
কালচারাল একাডেমির পরিচালক গীতিকার সুজন হাজং।সুজন হাজং জানান, আজ বেলা ১টা ৪০ মিনিটে কুমুদিনী হাজং নিজ
বাড়িতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ১০২ বছর। মৃত্যুকালে তিনি দুই ছেলে, দুই মেয়েসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী ও
আত্মীয়স্বজন রেখে গেছেন। দীর্ঘদিন ধরে কুমুদিনী হাজং বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন রোগে ভুগছিলেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি নিজ
বাড়িতে তার মেজ ছেলে অর্জুন হাজং ও তাঁর পরিবারের সঙ্গে বসবাস করতেন।তিনি আরও বলেন, ‘কুমুদিনী হাজংয়ের
অবদানকে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দেওয়া প্রয়োজন ছিল। তাঁকে জীবদশায় একুশে পদক বা স্বাধীনতা পদক দেওয়া যেত। তবে
রাষ্ট্রীয় পুরস্কার না পেলেও তিনি অগণিত মানুষের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা পেয়েছেন। তাঁর ত্যাগ ও সংগ্রামী চেতনার কাছে আমরা
হাজং সম্প্রদায় মাথা নত করি।’তার স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কুমুদিনী হাজংয়ের স্বামী লংকেশ্বর হাজং ২০০০ সালে
মারা যান। তিনি দুর্গাপুরবাসীর কাছে গর্ব ও গৌরবের সংগ্রামী মুখ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তাঁদের পাঁচ সন্তানের মধ্যে বড় ছেলে
লমিন হাজং আগেই মারা গেছেন। মেজ ছেলে অর্জুন হাজং নিজ গ্রামেই থাকেন। ছোট ছেলে সহদেব হাজং মুক্তিযুদ্ধের পর
ভারতে চলে যান। বড় মেয়ে মেনজুলি হাজং মানিকগঞ্জে ও ছোট মেয়ে অঞ্জুলী হাজং ঢাকায় থাকেন।বাংলাদেশ জাতীয়
হাজং সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক পল্টন হাজং জানান, মৃত্যুকালে কুমুদিনী হাজং তিন ছেলে ও দুই মেয়ে রেখে গেছেন।
তাঁর পরিবারের লোকজন ও আত্মীয়স্বজনেরা আসার পর তাদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আগামীকাল রবিবার সকালে সোমেশ্বরী নদীর
বিজয়পুর ঘাটে তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্নের কথা রয়েছে।ব্রিটিশ আমলে বৃহত্তর ময়মনসিংহের দুর্গাপুরের সুসং জমিদারি
এলাকায় টংক প্রথার প্রচলন ছিল। সে আমলে ফসল হোক বা না হোক, নির্দিষ্ট পরিমাণ ধান খাজনা হিসেবে জমিদারকে দিতে
হতো। পরে ১৯৩৭ সালে শোষিত কৃষকেরা এ প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন, যা ‘টংক আন্দোলন’ নামে পরিচিত।
কমিউনিস্ট নেতা কমরেড মনি সিংহের নেতৃত্বে টংক আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত হয় দুর্গাপুরের হাজং সম্প্রদায়ের
মানুষেরা। এরই অংশ হিসেবে কুমুদিনী হাজংয়ের স্বামী লংকেশ্বর হাজং এ অন্দোলনে জড়িত হন। ১৯৪৬ সালে ৩১ জানুয়ারি
তৎকালীন পুলিশ বগেরাতলী গ্রামে হানা দিয়ে কুমুদিনী হাজংকে উঠিয়ে নিয়ে যেতে চাইলে রাশিমনি হাজংয়ের নেতৃত্বে
পুলিশের ওপর হামলা চালানো হয়। এসময় কুমুদিনী হাজংকে পুলিশ নিতে পারেনি। তবে সেখানে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান
রাশিমনি হাজং ও সুরেন্দ্র হাজং। পুলিশেরও দুজন সদস্য নিহত হয়।হাজং বিদ্রোহের সাক্ষী কুমুদিনী হাজং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, টঙ্ক
আন্দোলন, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, পাকিস্তানি জুলুম, বৈষম্য, নিপীড়ন, মহান স্বাধীনতা আন্দোলনসহ বিভিন্ন
আন্দোলনের কালের স্বাক্ষি ছিলেন তিনি।তার মৃত্যুতে, স্থানীয় সংসদ সদস্য মোশতাক আহমেদ রুহী, আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয়
কমিটির সদস্য রেমন্ড আরেং, ইউএনও এম রকিবুল হাসান, সিপিবি কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা কমরেড দিবালোক সিংহ, ক্ষুদ্র নৃ-
গোষ্ঠীর পরিচালক গীতি কবি সুজন হাজং, দুর্গাপুর প্রেসক্লাব পরিবার, পথ পঠাগার পরিবার, বাংলাদেশ হাজং ছাত্র সংগঠন,
সিপিবি নেত্রকোনা জেলা ও দুর্গাপুর উপজেলা কমিটি সহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন শোকাহত পরিবারের প্রতি
সমবেদন জানিয়েছেন।সমাজসেবায় অবদানের জন্য ২০১৯ সালে কুমুদিনী হাজংকে সম্মানসূচক ফেলোশিপ দেয় বাংলা
একাডেমি। এ ছাড়া তিনি অনন্যা শীর্ষদশ [২০০৩], ড. আহমদ শরীফ স্মারক [২০০৫], কমরেড মণি সিংহ স্মৃতি পদক [২০০৭],
সিধু-কানহু-ফুলমণি পদক [২০১০], জলসিঁড়ি [২০১৪] ও হাজং জাতীয় পুরস্কার [২০১৮] পেয়েছেন।